'ঢাবি প্রশাসন ছাত্রলীগ নামক বাসের হেলপার'

‘অনিয়ম ও জালিয়াতির বিরুদ্ধে আমরা’ শিরোনামে মানববন্ধন করে কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। অপরাজেয় বাংলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১১ সেপ্টেম্বর। ছবি: আসিফ হাওলাদার
‘অনিয়ম ও জালিয়াতির বিরুদ্ধে আমরা’ শিরোনামে মানববন্ধন করে কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। অপরাজেয় বাংলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১১ সেপ্টেম্বর। ছবি: আসিফ হাওলাদার

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে বাসের সঙ্গে তুলনা করেছেন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ বাসের হেলপার। তাঁর অভিযোগ, অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না।

‘অনিয়ম ও জালিয়াতির বিরুদ্ধে আমরা’ শিরোনামে আজ বুধবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে মানববন্ধন শেষে কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশে হাসান আল মামুন এসব কথা বলেন।

গত মার্চে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে ছাত্রলীগের ৩৪ জন সাবেক ও বর্তমান নেতাকে নিয়মবহির্ভূতভাবে ভর্তির সুযোগ দেওয়ার প্রতিবাদে এর আয়োজন করা হয়।

গত রোববার প্রথম আলোয় ‘পরীক্ষা ছাড়াই ভর্তি হয়ে ডাকসু নেতা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ১১ ফেব্রুয়ারি ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ছাত্রলীগের ৩৪ জন সাবেক ও বর্তমান নেতা ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখতে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের মাস্টার অব ট্যাক্স ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামে ভর্তি হন। নির্বাচন করতে আগ্রহী এ ৩৪ জনের মধ্যে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সম্পাদক ও সদস্য পদে নির্বাচনে আটজন অংশ নেন। তাঁদের মধ্য বিজয়ী হন সাতজন। এ ছাড়া দুটি হল সংসদের ভিপি পদে অংশ নেন দুজন। এর মধ্যে একজন নির্বাচিত হন, অন্যজন পরাজিত হন। আরেকজন ছিলেন ছাত্রলীগের ডাকসু নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য। ভর্তির নীতিমালা অনুযায়ী, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই কেবল ওই প্রোগ্রামে ভর্তি হওয়া যায়। কিন্তু তাঁদের কেউই তাতে অংশ নেননি।

এদিকে গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম দাবি করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করা শিক্ষার্থীদের জন্য লিখিত পরীক্ষা ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের সন্ধ্যাকালীন কোর্সগুলোয় ভর্তির সুযোগ রয়েছে। যদিও একাধিক অনুষদের ডিন ও ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের একাধিক অধ্যাপক জানিয়েছেন, এমন কোনো সুযোগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই।

সমাবেশে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন অভিযোগ করে বলেন, নিয়মকানুন লঙ্ঘন করে ছাত্রলীগের ৩৪ জনকে চিরকুটের মাধ্যমে অবৈধভাবে ভর্তির সুযোগ দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন। এই উপাচার্য ও ডিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীর প্রতিনিধিত্ব করেন না। তাঁরা ছাত্রলীগের প্রতিনিধিত্ব করেন। অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের কোনো বিচার হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নামের যে বাসটি রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেই বাসের হেলপার।

পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক হাসান বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য কলঙ্কজনক ইতিহাসের মাস্টারমাইন্ড। ছাত্রলীগের ৩৪ জনকে পুরোপুরি অন্যায়ভাবে ভর্তির সুযোগ দিয়ে ডাকসু ও হল সংসদে কলঙ্কজনক নির্বাচনের মাধ্যমে তাঁদের বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছিল। এই জালিয়াতির মাধ্যমে ভর্তি হয়ে যাঁরা ডাকসু ও হল সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁদের পদ শূন্য ঘোষণা করে এসব পদে পুনর্নির্বাচন দিতে হবে। একই সঙ্গে উপাচার্য ও ডিনকে পদত্যাগ করতে হবে।

ঢাবির ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে চিরকুটের মাধ্যমে অবৈধ ভর্তির ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের নেতারা। ছবি: ছবি: আসিফ হাওলাদার
ঢাবির ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে চিরকুটের মাধ্যমে অবৈধ ভর্তির ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের নেতারা। ছবি: ছবি: আসিফ হাওলাদার

সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নাহিদ ইসলাম বলেন, মঙ্গলবার ডিন স্যার যে সংবাদ সম্মেলন করেছেন, সেখানে তিনি অনিয়মকে নিয়ম হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যেকোনো পর্যায়ে ছোট কোনো বিষয় নিয়ে গেলেও বলা হয় লিখিত দাও। এই বিশ্ববিদ্যালয় চলেই লিখিতের ওপর। কিন্তু শিবলী স্যার দেখাতে পারেননি, তাঁর বলা নিয়মটি কোথায় লেখা আছে। কারও মুখের কথায় কোনো নিয়ম তৈরি হতে পারে না। এই অবৈধ প্রক্রিয়ায় ভর্তি হয়ে যাঁরা ডাকসু ও হল সংসদে নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের পদ শূন্য ঘোষণা করে পুনর্নির্বাচন না দেওয়া হলে ডাকসুর প্রতি শিক্ষার্থীদের অনাস্থা আরও বাড়বে। আর যে ৩৪ জন চিরকুটের মাধ্যমে অবৈধভাবে ভর্তি হয়েছিলেন, তাঁদের বহিষ্কার করতে হবে।

উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানের মতো ‘চিরকুট’ উপাচার্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে কখনো আসেননি বলে মন্তব্য করেন সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক মশিউর রহমান।

সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক বিন ইয়ামিন মোল্লার সঞ্চালনায় সমাবেশে অন্যদের মধ্যে যুগ্ম আহ্বায়ক সোহরাব হোসেন বক্তব্য দেন। মিছিল শেষে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেন তাঁরা।

জড়িতদের শাস্তি দাবি করে ছাত্রদলের মিছিল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে চিরকুটের মাধ্যমে অবৈধ ভর্তির ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল। এই দাবিতে আজ বুধবার দুপুরে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেছে সংগঠনটি।

দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য থেকে মিছিল বের করে ছাত্রদল। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সভাপতি আল মেহেদী তালুকদারের নেতৃত্বে মিছিলটি ক্যাম্পাসের শিববাড়ি এলাকায় গিয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে মিলিত হয়। অবৈধভাবে চিরকুটের মাধ্যমে ডাকসুতে নির্বাচিত ব্যক্তিদের পদ থেকে অব্যাহতি ও বহিষ্কারের দাবি জানান ছাত্রদলের নেতারা।

ছাত্রদলের মিছিল ও সমাবেশে আরও উপস্থিত ছিলেন ডাকসু নির্বাচনে সংগঠনটির প্যানেল থেকে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী আনিসুর রহমান খন্দকার, স্যার এ এফ রহমান হল শাখা ছাত্রদলের সদস্যসচিব মমিনুল ইসলাম জিসান প্রমুখ।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আজ দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) সঞ্জীব চত্বরে সংবাদ সম্মেলন করেন বামপন্থী কয়েকটি ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মী ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে চিরকুটের মাধ্যমে অবৈধভাবে ভর্তি হয়ে ডাকসুতে নির্বাচিত ব্যক্তিদের পদত্যাগ দাবি করেন তাঁরা।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান ছাত্র ইউনিয়নের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক রাগীব নাঈম।

সংবাদ সম্মেলন করে চিরকুটের মাধ্যমে অবৈধভাবে ভর্তি হয়ে ডাকসুতে নির্বাচিত ব্যক্তিদের পদত্যাগ দাবি করেন বামপন্থী কয়েকটি ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মী ও সাধারণ শিক্ষার্থী একটি অংশ। সঞ্জীব চত্বর, টিএসসি, ঢাবি, ১১ সেপ্টেম্বর। ছবি: আসিফ হাওলাদার
সংবাদ সম্মেলন করে চিরকুটের মাধ্যমে অবৈধভাবে ভর্তি হয়ে ডাকসুতে নির্বাচিত ব্যক্তিদের পদত্যাগ দাবি করেন বামপন্থী কয়েকটি ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মী ও সাধারণ শিক্ষার্থী একটি অংশ। সঞ্জীব চত্বর, টিএসসি, ঢাবি, ১১ সেপ্টেম্বর। ছবি: আসিফ হাওলাদার

লিখিত বক্তব্যে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে অবৈধভাবে ভর্তির ঘটনার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে নিয়োগ-বাণিজ্যের প্রসঙ্গটিও উঠে আসে। রোকেয়া হলে নিয়োগ-বাণিজ্যে জড়িত হল সংসদের ভিপি, জিএস, এজিএস এবং ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের সান্ধ্য কোর্সে নিয়মবহির্ভূতভাবে ভর্তি হয়ে ডাকসু ও হল সংসদে নির্বাচিত আট নেতার প্রত্যেকের ছাত্রত্ব বাতিলের দাবি জানান এসব শিক্ষার্থী।

তাঁদের প্রথম দাবিটি হলো নিয়োগ-বাণিজ্যের ঘটনায় ‘জড়িত’ রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক জিনাত হুদার পদত্যাগ এবং ছাত্রলীগের ৩৪ জনকে নিয়মবহির্ভূতভাবে ভর্তির সুযোগ দেওয়ায় উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান ও ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিনের পদত্যাগ।

সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের (মার্ক্সবাদী) বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সালমান সিদ্দিকী, ছাত্র ফেডারেশনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সালমান ফরাজি, রোকেয়া হলের ছাত্রী শ্রবণা শফিক দীপ্তি প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।