ঢাবিতে পরীক্ষা ছাড়া ভর্তি: ডিনের বক্তব্যে নতুন বিতর্ক, অন্য শিক্ষকেরা বিস্মিত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসুর ৮ নেতাসহ ৩৪ শিক্ষার্থীর ভর্তিতে অনিয়ম নিয়ে প্রথম আলোতে প্রকাশিত সংবাদের ব্যাখ্যা দিতে মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের ডিন শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম। ছবি: আবদুস সালাম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসুর ৮ নেতাসহ ৩৪ শিক্ষার্থীর ভর্তিতে অনিয়ম নিয়ে প্রথম আলোতে প্রকাশিত সংবাদের ব্যাখ্যা দিতে মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের ডিন শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম। ছবি: আবদুস সালাম

লিখিত পরীক্ষা ছাড়াই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের সন্ধ্যাকালীন কোর্সগুলোয় ভর্তির সুযোগ রয়েছে। সংবাদ সম্মেলন করে গত মঙ্গলবার এই তথ্য তুলে ধরার পর নতুন করে বিতর্কের মুখে পড়েছেন বাণিজ্য অনুষদের ডিন শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম। তাঁর এই বক্তব্য সঠিক নয় বলে জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন, চেয়ারম্যান ও অধ্যাপকদের অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলছেন, বিজ্ঞপ্তি এবং ভর্তি পরীক্ষা ছাড়া এসব কোর্সে ভর্তির সুযোগ নেই।

পরীক্ষা ছাড়া ছাত্রলীগের ৩৪ নেতা-কর্মীকে ভর্তির প্রতিবাদে গতকাল বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মানববন্ধন, বিক্ষোভ সমাবেশ ও সংবাদ সম্মেলন করেছে ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন। গতকাল সন্ধ্যায় টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের সামনে উপাচার্য ও ডিনের কুশপুত্তলিকা দাহ করেছে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) পরীক্ষা ছাড়া ভর্তির এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে।

গত রোববার প্রথম আলোয় ‘পরীক্ষা ছাড়াই ভর্তি হয়ে ডাকসু নেতা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, গত ১১ ফেব্রুয়ারি ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ছাত্রলীগের ৩৪ জন সাবেক ও বর্তমান নেতা ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখতে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের মাস্টার অব ট্যাক্স ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামে ভর্তি হন। এই ৩৪ জনের মধ্যে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদে বিজয়ী ৭ জন নেতা রয়েছেন।

ওই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে চারটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের হাবিবুল্লাহ বাহার সম্মেলনকক্ষে সংবাদ সম্মেলন করেন শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ছাড়াই ভর্তি করা হয়—সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানালেও ডিন এই নিয়মের অনুলিপি দিতে পারেননি। তিনি বলেছেন, অনুষদের ‘চেয়ারম্যানস কমিটিতে’ এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে কবে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেটিও তিনি বলতে পারেননি। সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া আশ্বাস অনুযায়ী গতকাল সেই সিদ্ধান্তের কপি সাংবাদিকদের দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যোগাযোগ করা হলে ডিনের কার্যালয় থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি।

তবে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের একাধিক বিভাগের সাবেক ও বর্তমান চেয়ারম্যান এবং অধ্যাপক প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন যে বাণিজ্য অনুষদে এমন সিদ্ধান্ত হয়নি। ভর্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে তা বিভাগের একাডেমিক কমিটি, অনুষদ কমিটি, ডিনস কমিটি হয়ে অবশ্যই একাডেমিক কাউন্সিল এবং সিন্ডিকেটে অনুমোদন নিতে হবে।

ভর্তির এই নিয়মের পরিবর্তন এবং সেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল বা সিন্ডিকেট অনুমোদিত কি না, জানতে চাইলে ডিন শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ধ্যাকালীন প্রোগ্রামগুলো অনুষদের নিজস্ব প্রোগ্রাম। এ ধরনের প্রোগ্রামে কোনো পরিবর্তনের জন্য তাঁদের একাডেমিক কাউন্সিল বা সিন্ডিকেটে যেতে হয় না। 

শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলামের এই বক্তব্য প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম প্রথম আলোকে বলেন, পরীক্ষা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কোনো সুযোগ নেই। বিভাগের পক্ষ থেকে ভর্তির বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। বিভিন্ন খাতের অনেকেই আবেদন করেন। এরপর লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। তাঁর মতে, সব অনুষদের জন্যই একই নিয়ম প্রযোজ্য। 

এই নীতিমালা ২০১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর সিন্ডিকেটে অনুমোদন করা হয় বলে একজন শিক্ষক জানিয়েছেন।

শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম যে সময়ে ভর্তির নিয়মে পরিবর্তন আনার কথা বলেছেন, তখন ফিন্যান্স বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন কিসমাতুল আহসান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা দিতে হবে না—এমন কোনো সিদ্ধান্তের কথা তিনি মনে করতে পারছেন না। এই অনুষদের সন্ধ্যাকালীন কোর্সগুলোয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও পরীক্ষা দিয়েই ভর্তি হচ্ছেন। 

বাণিজ্য অনুষদের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের সন্ধ্যাকালীন মাস্টার্স প্রোগ্রামের পরিচালক আবু হেনা রেজা হাসান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের সন্ধ্যাকালীন এমবিএ বা মাস্টার্স প্রোগ্রামে যাঁরা ভর্তি হন, তাঁদের প্রত্যেককে পরীক্ষা দিয়েই ভর্তি হতে হয়।

 শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ

অবৈধ ভর্তির প্রতিবাদে গতকাল দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে মানববন্ধন করেন কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতা-কর্মীরা। এ ছাড়া এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি দাবি করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল। ছাত্রদলের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আল মেহেদী তালুকদারের নেতৃত্বে ছাত্রদলের একটি মিছিল ক্যাম্পাসের শিববাড়ি এলাকায় সমাবেশ করে। অবৈধভাবে ভর্তি হওয়া নেতাদের ডাকসু থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কথা জানান ছাত্রদলের নেতারা।

দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের সঞ্জীব চত্বরে সংবাদ সম্মেলন করে বামপন্থী কয়েকটি ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মী ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান ছাত্র ইউনিয়নের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক রাগীব নাঈম। লিখিত বক্তব্যে ডাকসু ও হল সংসদে নির্বাচিত নেতাদের ছাত্রত্ব বাতিলের দাবি জানানো হয়।

সুষ্ঠু তদন্ত চায় টিআইবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অবৈধ ভর্তির মতো আত্মঘাতী অবস্থান প্রতিরোধ করার আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি। এক বিবৃতিতে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পরীক্ষা ছাড়া ভর্তির অভিযোগ বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ তথা মেধাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সব প্রত্যাশার জন্য অশনিসংকেত। একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা ও সুনাম অক্ষুণœরাখার জন্য অপরিহার্য, অন্যদিকে নিয়মনীতি অনুসরণ করে সমান প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র নিশ্চিত করে স্বচ্ছতার মাধ্যমে ভর্তিপ্রত্যাশী সব শিক্ষার্থীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার বাস্তব দৃষ্টান্ত স্থাপন করাও কর্তৃপক্ষের গুরুদায়িত্ব। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্বের অবস্থাকে রাজনৈতিক বা অন্য কোনো সুবিধা অর্জনের মাধ্যম হিসেবে পরিণত করার যেকোনো প্রয়াসকে কর্তৃপক্ষ প্রতিহত করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।