জিপি ও রবিতে প্রশাসক বসাতে চায় বিটিআরসি

দেশের দুই শীর্ষ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি গ্রামীণফোন ও রবিতে প্রশাসক বসিয়ে পাওনা টাকা আদায় করতে চায় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। সংস্থাটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিচ্ছেন, এ ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত সরকারের সায় আছে। পাশাপাশি আইনেও প্রশাসক নিয়োগের সুযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ৪৬ ধারা অনুযায়ী, কোনো অপারেটর লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করলে তার লাইসেন্স বাতিল ও স্থগিত করতে পারে বিটিআরসি। লাইসেন্স স্থগিত করা হলে সরকারের অনুমোদন নিয়ে প্রশাসক (অ্যাডমিনিস্ট্রেটর বা রিসিভার) নিয়োগ দেওয়া যায়।

প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হলে অপারেটরদের পরিচালনা পর্ষদ ও প্রধান নির্বাহীর কোনো ক্ষমতা থাকবে না। বিটিআরসির কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের নিয়োগ করা প্রশাসক প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি না করে পাওনা টাকা পরিশোধ করতে পারবেন। পরিশোধ করা শেষ হলে সরকারও প্রশাসক তুলে নেবে। এখন পর্যন্ত এটাই চিন্তা।

জানতে চাইলে বিটিআরসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. রেজাউল কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দুই অপারেটরকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছি। তাদের জবাব সন্তোষজনক না হলে টাকা উদ্ধারে আইন অনুযায়ী যেসব পদক্ষেপের সুযোগ আছে, তা নেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, গ্রাহকের স্বার্থ সুরক্ষা করে কমিশন আইন মেনে যেকোনো পদক্ষেপ নিতে পারে।

বিটিআরসির দাবি অনুযায়ী, গ্রামীণফোন ও রবির কাছে প্রতিষ্ঠানটির পাওনা ১৩ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের কাছে ১২ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা এবং রবির কাছে ৮৬৭ কোটি টাকা। এ টাকা আদায়ে ব্যান্ডউইডথ সীমিত করা এবং প্যাকেজ ও সরঞ্জামের ছাড়পত্র (এনওসি) দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল বিটিআরসি। তাতে কোনো কাজ না হওয়ায় এরপর ৫ সেপ্টেম্বর দুই অপারেটরকে লাইসেন্স (টু-জি ও থ্রি-জি) বাতিল কেন করা হবে না, তা জানতে চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়। জবাবের সময় ৩০ দিন।

চিঠির পর গ্রামীণফোন বরাবরের মতোই পদক্ষেপটিকে অযৌক্তিক বলে অভিহিত করেছে। রবি বলেছে, তারা সময়মতো চিঠির জবাব দেবে। সব মিলিয়ে বিষয়টি সহজে সুরাহা হবে, এমন কোনো ইঙ্গিত বিটিআরসি ও দুই অপারেটরের কাছ থেকে মিলছে না।

বিটিআরসির চিঠির আগেই নিরীক্ষার বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে জেলা দায়রা জজ আদালতে মামলা করেছে গ্রামীণফোন ও রবি। গত ২৫ আগস্ট রবি প্রথমে মামলা করে, পরের দিন মামলা করে গ্রামীণফোন।

এ বিষয়ে প্রথম আলোকে দেওয়া এক বক্তব্যে গ্রামীণফোন কর্তৃপক্ষ বলেছে, যে নিরীক্ষার ভিত্তিতে বিটিআরসি অর্থ দাবি করছে, সেটা অযৌক্তিক। নিরীক্ষাটির প্রক্রিয়া, কার্যপ্রণালি ও ফলাফলের বিপক্ষে গ্রামীণফোন বারবার আপত্তি জানিয়েছে। বারবার সালিসসহ স্বচ্ছ গঠনমূলক আলোচনার আহ্বান জানিয়েছে। দুঃখজনকভাবে বিটিআরসি সব প্রচেষ্টা অগ্রাহ্য করেছে এবং এই অযৌক্তিক নিরীক্ষা দাবি আদায়ে অন্যায্যভাবে বল প্রয়োগ করেই যাচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামীণফোন একটি দেওয়ানি মামলা দায়ের করতে বাধ্য হয়েছে।

রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিটিআরসির নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উত্থাপিত আপত্তিগুলো প্রশ্নবিদ্ধ। আলাপ-আলোচনা এবং বিকল্প সালিস নিষ্পত্তির (আরবিট্রেশন) মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানে আমরা সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সঙ্গে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বিটিআরসি আমাদের প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে অর্থ আদায়ে আইনবহির্ভূত পদক্ষেপ নিয়েছে।’ তিনি বলেন, সমস্যা সমাধানে আদালতের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া রবির কোনো বিকল্প ছিল না। বিষয়টি বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন। এ বিষয়ের ওপর এ মুহূর্তে আর কোনো মন্তব্য করা সমীচীন নয়।

>

গ্রামীণফোনের কাছে ১২,৫৮০ কোটি টাকা পাওনা
রবির কাছে পাওনা ৮৬৭ কোটি টাকা
নিরীক্ষা দাবিকে অযৌক্তিক বলছে দুই অপারেটর
মামলা করেছে গ্রামীণফোন ও রবি
লাইসেন্স বাতিলের কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে বিটিআরসি
প্রশাসক বসানোর সুযোগ আইনে আছে, তবে নজির নেই

গ্রামীণফোন ও রবি দেশের সবচেয়ে বড় দুই মোবাইল ফোন অপারেটর। নরওয়েভিত্তিক টেলিনর গ্রুপের প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোন ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশে কাজ শুরু করে। এটি বাংলাদেশের পুঁজিবাজারেও নিবন্ধিত। দেশের ১৬ কোটি ১৮ লাখ মুঠোফোন গ্রাহকের সাড়ে ৭ কোটিই তাদের। অন্যদিকে রবি মালয়েশিয়ার আজিয়াটা বারহাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। তাদের গ্রাহকসংখ্যা ৪ কোটি ৭৯ লাখ, যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

বড় দুটি বিদেশি বিনিয়োগকারীর লাইসেন্স বাতিলসংক্রান্ত কারণ দর্শানোর চিঠি বিদেশি বিনিয়োগের ওপর কোনো প্রভাব ফেলে কি না, জানতে চাইলে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সংগঠন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি শেহজাদ মুনিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সব সময় আলোচনার মাধ্যমে সমাধান কামনা করি। এ ধরনের ঘটনা ব্যবসার পরিবেশের জন্য কখনোই ভালো নয়।’

এফআইসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি রূপালী চৌধুরী এ নিয়ে বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা স্বচ্ছ আইনকানুনের মধ্যে ব্যবসা করতে চায়। একটি প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক নিয়োগের তৎপরতার খবর বিনিয়োগকারীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই বিষয়টি সমঝোতার মাধ্যমে সুরাহা করা উচিত।

নিরীক্ষা দাবির ইতিবৃত্ত
অপারেটরদের কাছ থেকে রাজস্বের ভাগ (সাড়ে ৫ শতাংশ), বিভিন্ন ফি বা মাশুল ও করের টাকা আদায় করে বিটিআরসি। সংস্থাটি জানিয়েছে, অপারেটরগুলো ঠিকমতো পাওনা টাকা দিয়েছে কি না, তা যাচাইয়ে গ্রামীণফোনের ওপর ১৯৯৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত একটি নিরীক্ষা করা হয়। এতে ৩ হাজার ৩৪ কোটি টাকা পাওনা দাবি করা হয়।

এই নিরীক্ষা দাবি নিয়ে গ্রামীণফোন আদালতে যায়। বিটিআরসি বলছে, নিরীক্ষক নিয়োগের একটি প্রক্রিয়াগত ভুলের কারণে সেযাত্রায় তারা আদালতে সফল হয়নি। তবে আদালত নিরীক্ষা আপত্তিগুলো নাকচ করেনি। এরপর বিটিআরসি মেসার্স তোহা খান জামান এবং সহযোগী ফার্ম সিএনকে অ্যাসোসিয়েটস এলএলপি ও চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্টস ইন্ডিয়াকে নিরীক্ষক নিয়োগ দিয়ে ১৯৯৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ের নিরীক্ষা করায়।

বিটিআরসি জানিয়েছে, গ্রামীণফোনের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক ও মতামত নিয়ে চূড়ান্ত দাবি ১২ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা (বিটিআরসির ৮ হাজার ৪৯৪ কোটি ও এনবিআরের ৪ হাজার ৮৬ কোটি) নির্ধারণ করা হয়। এরপর ২০১৯ সালের ২ এপ্রিল পাওনা চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়। অন্যদিকে গ্রামীণফোন বলছে, তাদের সঙ্গে বৈঠক ও চিঠি চালাচালি হলেও আপত্তি গ্রহণ করা হয়নি।

গ্রামীণফোন বিষয়টি নিয়ে দুই দফা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, পাওনা দাবির বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরা হলেও সেটা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। যেমন বিটিআরসি অপারেটরদের কাছ থেকে রাজস্বের ভাগ পাবে। কিন্তু নিরীক্ষায় নিজস্ব ভবনের কিছু অংশ ভাড়া দিয়ে পাওয়া টাকা এবং ব্যাংকে রাখা টাকার সুদ বাবদ পাওয়া অর্থও গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় করা রাজস্বের মধ্যে দেখিয়ে নিরীক্ষা দাবি তোলা হয়েছে।

নিরীক্ষার বিষয়ে গত বুধবার প্রথম আলোকে দেওয়া গ্রামীণফোন কর্তৃপক্ষের বক্তব্য হলো, বিটিআরসি শুধু ২০১৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গ্রামীণফোনের প্রতিক্রিয়াগুলো বিবেচনায় নিয়েছে। কিন্তু চূড়ান্ত প্রতিবেদন নিয়ে বিটিআরসির চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামীণফোন গত সেপ্টেম্বর মাসে দুটি চিঠিতে যুক্তিতর্ক তুলে ধরলেও সেগুলো আমলে নেওয়া হয়নি।

রবির ওপর নিরীক্ষা করা হয় ১৯৯৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত। মসিহ মুহিত হক এবং তাঁর সহযোগী পি কে এফ শ্রীধর, সান্থানাম এলএলপি ও চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্টস ইন্ডিয়া নিরীক্ষার দায়িত্ব পালন করে। তারা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর। এটির বিষয়ে রবি আজিয়াটা মতামত দেয় ২০১৮ সালের ১৮ এপ্রিল। এরপর ত্রিপক্ষীয় সভা হয়।

রবির বক্তব্য ও প্রমাণ বিবেচনায় নিয়ে পাওনা দাবির পরিমাণ ৩৮৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা কমিয়ে ৮৬৭ কোটি টাকা ধরা হয়। এরপর পাওনা চেয়ে তিন দফা চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে বিটিআরসি। রবি এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো সংবাদ সম্মেলন করেনি। তবে গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে বলেছে, তারা নিরীক্ষা দাবির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে।

আইনজীবী অনিক আর হক এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আইন ও লাইসেন্সের শর্ত খতিয়ে দেখেছি, সেখানে সালিসের কোনো সুযোগ নেই। গ্রামীণফোন ও রবি আদালতে যাওয়ার ফলে টাকা আদায়ের বিষয়টি সুরাহা হতে সময় লাগবে। বিটিআরসি যদি পাবলিক রিকভারি অ্যাক্টের অধীনে মামলা করত, তাহলেও বিষয়টি সমাধান হতে দীর্ঘ সময় লাগত।’ তিনি বলেন, গ্রামীণফোন ও রবি যেহেতু আদালতে গেছে, সেহেতু বিটিআরসি কোনো পদক্ষেপ নিলে সেটা নিয়ে হাইকোর্টে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

প্রশাসক বসানো সম্ভব কি না
২০১২ সালে দেশীয় একটি প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক বসানোর সুযোগ তৈরি করতে গিয়ে পিছু হটতে হয়েছিল সরকারকে। সরকার চেয়েছিল কোম্পানি আইনে একটি সংশোধনী আনতে, যাতে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানি ডেসটিনিতে প্রশাসক নিয়োগ করা যায়। কিন্তু এতে সব প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক নিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়, এই আশঙ্কায় ব্যবসায়ীরা ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেন। এরপর আইন সংশোধনের প্রক্রিয়া আর এগোয়নি।

বিদেশি বহুজাতিক বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দিতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বিনিয়োগ সুরক্ষা চুক্তি আছে। আবার কোনো বিরোধ নিয়ে বিনিয়োগকারীরা আন্তর্জাতিক আদালতেও যেতে পারে। সামগ্রিকভাবে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ওপর এ ধরনের ঘটনার প্রভাব কী হয়, সেটাই বড় প্রশ্ন।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান সামগ্রিক বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, বেসরকারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে প্রশাসক বসানোর নজির বাংলাদেশে নেই। গ্রামীণফোন ও রবির কাছ থেকে পাওনা আদায়ের বিষয়টি যে পর্যায়ে এসেছে, সে পর্যন্ত আসাই উচিত হয়নি। তিনি বলেন, বিশ্বের বড় কোম্পানিগুলোর মধ্যে টেলিনর ও আজিয়াটা রয়েছে। গ্রামীণফোন ও রবির লাইসেন্স বাতিল বা প্রশাসক বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হলে সেটা বিশ্বব্যাপী বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করবে। তাই মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি করা উচিত। বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টারের (বিয়াক) মাধ্যমেও বিষয়টি মধ্যস্থতা করানো যেতে পারে।