রোহিঙ্গা শিবিরের কারণে হাতির ১২ পথ বন্ধ

হাতি। ফাইল ছবি
হাতি। ফাইল ছবি

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের কয়েক হাজার একর বনভূমিতে তৈরি হয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ৩৪টি আশ্রয়শিবির। এসব আশ্রয়শিবিরের কারণে হাতি চলাচলের ১২টি করিডর বন্ধ ও ২০টিরও বেশি প্রাকৃতিক জলাধার ধ্বংস হয়েছে। বনাঞ্চল উজাড় করে শিবির তৈরির পর বন্য হাতির পাল সেখানে আটকা পড়েছে। বাধাগ্রস্ত হয়েছে তাদের চলাচলের পথ। হাতির আক্রমণ থেকে শরণার্থীদের রক্ষায় আশ্রয়শিবিরে নানা কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলেও হাতি রক্ষায় নেওয়া হয়নি কোনো পদক্ষেপ।

বন বিভাগের তথ্যমতে, কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের আওতাধীন উখিয়া ও টেকনাফের বনাঞ্চলে দুই বছর ধরে তীব্র খাদ্য ও পানিসংকটে রয়েছে ৬৭টি বন্য হাতি। এর মধ্যে রোহিঙ্গাশিবিরের কারণে ৪০টি হাতির চলাচলের পথ বন্ধ হওয়ায় সেগুলো সেখানে আটকা পড়েছে। ছয় হাজারের বেশি বনাঞ্চল উজাড়, হাতি চলাচলের অন্তত ১২টি করিডর (রাস্তা) বন্ধ, ২২টির বেশি প্রাকৃতিক জলাধার (খাল, ছড়া) ধ্বংস হওয়ায় হাতিগুলো খাদ্য ও পানির সংকটে পড়েছে। এতে হাতিগুলো আক্রমণাত্মক হয়ে লোকালয়ে হানা দিচ্ছে। গত দুই বছরে বন্য হাতির আক্রমণে টেকনাফ ও উখিয়ায় মারা গেছেন অন্তত ২৭ জন। এর মধ্যে ১৩ জনই রোহিঙ্গা। সর্বশেষ গত জুন মাসে হাতির আক্রমণে রামুতে দুই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছিল। গত দুই বছরে টেকনাফের বাহারছড়া ও উখিয়ার ইনানী বনাঞ্চলে রোগাক্রান্ত হয়ে মারা গেছে দুটি হাতি। বন বিভাগের দাবি বার্ধক্যজনিত কারণে হাতি দুটোর মৃত্যু হয়েছিল।

বন্য হাতির নজরদারিতে ৯৪ পর্যবেক্ষণ টাওয়ার

গতকাল মঙ্গলবার সকালে উখিয়ার মধুরছড়ার আশ্রয়শিবির ঘুরে দেখা গেছে, কয়েকটি পাহাড়ের পাশে প্রাকৃতিক খাল ও ছড়া বন্ধ করে সেখানে তৈরি হয়েছে অসংখ্য রোহিঙ্গা বসতি। খাল ও ছড়ায় পানি নেই।

শিবিরের রোহিঙ্গা কামাল উদ্দিন (৪৫) বলেন, দুই বছর আগে তিনি এখানে পানিতে টইটম্বুর খাল দেখেছেন। শত শত রোহিঙ্গা খালে নেমে গোসল করেছে। কয়েকবার খালের পাশ দিয়ে বন্য হাতির আসা–যাওয়াও দেখেছেন। কিন্তু এক বছর ধরে সেখানে হাতির দেখা নেই।

কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক ও হিমছড়ি জাতীয় উদ্যান সহব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি আয়াছুর রহমান বলেন, মধুরছড়া আশ্রয়শিবির এলাকাটি দুই বছর আগেও বন্য হাতির অভয়াশ্রম ছিল। হাতির ভয়ে সেখানে কেউ যাওয়ার সাহস পেত না। এখন কয়েক হাজার একরের পাহাড় সাবাড় এবং ছয়-সাতটি প্রাকৃতিক খাল-ছড়া (জলাধার) ধ্বংস করে তৈরি হয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ আশ্রয়শিবির। যেখানে বসবাস করছে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা। আশ্রয়শিবির তৈরির পর হাতি চলাচলের ১০-১২টি করিডর (রাস্তা) বন্ধ হয়ে গেছে।

শিবিরের পশ্চিম অংশে বনাঞ্চলের পাশে তৈরি হয়েছে একাধিক উঁচু পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। লোকজন টাওয়ারে বসে বন্য হাতি চলাচলের ওপর লক্ষ্য রাখে প্রতিনিয়ত। বন্য হাতির উপস্থিতি দেখা মাত্র বাঁশি বাজিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সতর্ক করা হয়।

জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থা-ইউএনএইচসিআর এবং ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার-আইইউসিএন যৌথভাবে পর্যবেক্ষণ টাওয়ারগুলো নির্মাণ ও তত্বাবধান করছে।

আইইউসিএন-এর কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুল মোতালেব প্রথম আলোকে বলেন বলেন, ২০১৮ সালে আইইউসিএন-এর সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, টেকনাফ ও উখিয়ার বনাঞ্চলে বর্তমানে ৬৭টি হাতি আছে। এরমধ্যে ৪০টি হাতি আটকা পড়েছে রোহিঙ্গা শিবির এলাকায়।

আটকে পড়া হাতির আবাসস্থল গড়তে ইতিমধ্যে ৫০ হেক্টর বাগান সৃজন করা হয়েছে। বন বিভাগের উদ্যোগে সৃজিত হচ্ছে আরও ৫ হাজার একর বনায়ন। তবে ক্যাম্পের ভেতর দিয়ে হাতি চলাচলের করিডরগুলো এখনও উন্মুক্ত হয়নি। করিডরগুলো দ্রুত উন্মুক্তকরণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বন্য হাতির খাবার-পানিসংকট নিরসনে শিবিরের অভ্যন্তরের প্রাকৃতিক জলাধারগুলো উদ্ধার ও খনন করার প্রস্তুতি চলছে।

বন বিভাগের তথ্যমতে, ২০১০ সালের ২৪ মার্চ হাতি সংরক্ষণের জন্য ২৮ হাজার ৬৮৮ একর বনভূমি নিয়ে ‘টেকনাফ গেইম রিজার্ভ’ গঠন হয়।