রাজধানীতে পুলিশ পাহারায় চলত জুয়া

রাজধানীর চারটি ক্যাসিনোতে গত বুধবার অভিযান চালানো হয়। ছবি: প্রথম আলো
রাজধানীর চারটি ক্যাসিনোতে গত বুধবার অভিযান চালানো হয়। ছবি: প্রথম আলো

রাজধানীর অনেক ক্লাবের প্রচলিত জুয়ার আসরকে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও উপকরণসজ্জিত করে ক্যাসিনোতে রূপান্তর করেন একদল নেপালি। জুয়া চালাতে তাঁদের ভাড়া করে আনেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের কিছু নেতা-কর্মী। চুক্তির বিনিময়ে এসব নেপালি কাজ করলেও জুয়ার মূল টাকা যেত নেতাদের পকেটে। আর জুয়ার কারবার নির্বিঘ্ন করত পুলিশ প্রশাসন।

গত বুধবার রাজধানীর চারটি ক্যাসিনোতে অভিযান ও একটি ক্যাসিনোর মালিককে গ্রেপ্তারের পর এমন তথ্য দিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা। র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক সারোয়ার বিন-কাশেম বলেন, অবৈধ ক্যাসিনো নিয়ে আরও তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা হচ্ছে। নিশ্চিত তথ্য-প্রমাণ নিয়ে আরও অভিযান হবে।

বুধবারের অভিযানের পর গতকাল বৃহস্পতিবার আর কোনো অভিযান হয়নি। তবে আতঙ্ক ভর করেছে সরকারি দলের অনেক নেতা–কর্মীর মধ্যে, যাঁদের প্রায় সবাই যুবলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্বে রয়েছেন। অবশ্য চার ক্যাসিনোতে অভিযানের পর একটি ক্যাসিনোর মালিক যুবলীগ নেতা বুধবার রাতে শত শত কর্মী নিয়ে নিজের কার্যালয়ে অবস্থান করে শক্তি দেখান। সংশ্লিষ্টদের অনেকে মনে করছেন, প্রভাবশালীদের চাপে এ অভিযান আর এগোবে না। এই ফাঁকে ক্যাসিনোর মালিক ও পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা সবকিছু গুটিয়ে ফেলবেন।

তবে অনেকে আকস্মিক এই অভিযানের নেপথ্যে নানা কারণ খুঁজছেন। কেউবা বলছেন, ক্যাসিনো ব্যবসায় জড়িত ব্যক্তিরা কাঁচা টাকার দাপটে তাঁদের গডফাদারদেরও পাত্তা দিচ্ছিলেন না। কারও কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ, নিজেদের অন্যায় অব্যাহত রেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে চাপের মুখে রাখছিলেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে তাঁদের কর্মকাণ্ডের খবর পৌঁছায়। আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সভায় গত শনিবার এ নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। গতকাল বৃহস্পতিবারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ছাত্রলীগের পর যুবলীগ ধরেছি।’

রাজধানীর গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্র, ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ও ওয়ান্ডারার্স এবং বনানীর গোল্ডেন ঢাকা ক্লাবের জুয়ার আসরে অভিযান চালিয়ে বুধবার রাতে সেগুলো সিলগালা করে দেয় র‌্যাব। চারটি ক্যাসিনো থেকে বিপুল পরিমাণ মদ, বিয়ার, ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা ১৮২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। এর মধ্যে ইয়ংমেনস ক্লাবে সভাপতি ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে নেওয়া হয়।

এত দিন রাজধানীতে ক্লাবে বা আড্ডায় জুয়ার আসরের কথা শোনা গেলেও আধুনিক ক্যাসিনোর অস্তিত্ব থাকার খবর একেবারেই নতুন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, অন্তত ৫৬টি ক্যাসিনোর তালিকা তাঁদের হাতে আছে।

>

রাজধানীতে জুয়ার আসর আগে থেকেই ছিল
এবার ক্যাসিনোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান
রাজধানীতে ৫৬টি জুয়ার ক্লাব
র্যাব-পুলিশের হাতে তালিকা

প্রশ্ন উঠেছে, এই ক্যাসিনোগুলো হঠাৎ গড়ে ওঠেনি, তাহলে অনেক দিন কী চলছিল।কারাই বা চালাচ্ছিলেন? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এসব জানতেন?—এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘ঢাকায় কিছু অবৈধ ক্যাসিনো চলছিল বলে শুনছিলাম। সে অনুযায়ী কাল রাতে ক্যাসিনো সিলগালা করা হয়েছে। সেগুলো অনুমতি ছাড়া করেছিল। এর আগেও খবর আসছিল কলাবাগান ক্লাবের বিষয়ে। সেটা বন্ধ করা হয়েছে। কারওয়ান বাজারে একটি হয়েছিল, সেটাও বন্ধ করা হয়েছে।’

আরেক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কে কতখানি জড়িত, কে কতখানি সহযোগিতা করেছে, কে কতখানি ব্যবস্থা নিয়েছে, এগুলো তদন্তের পর জানা যাবে। তদন্তের পর বেরিয়ে আসবে কে কোনটার সঙ্গে জড়িত ছিল, কার কতখানি ভূমিকা ছিল। এখানে যদি প্রশাসনের লোক জড়িত থাকে বা সহযোগিতা করে থাকে, তাহলে তিনিও আইনানুযায়ী বিচারের মুখোমুখি হবেন।

একই সুরে কথা বলেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম। গতকাল তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ঢাকায় অবৈধ জুয়ার আড্ডা বা কোনো ধরনের ক্যাসিনো পরিচালনা করতে দেওয়া হবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এত দিন কেন ব্যবস্থা নেয়নি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে আমরা কঠোর হব। আমরা ক্যাসিনোর তালিকা করছি।’

বুধবার রাজধানীর যে চারটি ক্লাবে অভিযান হয়েছে, তার একটি ঢাকা ওয়ান্ডারার্স। এটি মতিঝিল থানার খুব কাছেই। শুধু তা-ই নয়, মতিঝিল থানার এক কিলোমিটারের মধ্যে আটটি ক্লাব। এর মধ্যে রয়েছে ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস, আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব, সোনালী অতীত ক্রীড়াচক্র, দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব, আরামবাগ ক্লাব ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। থানার সামনে বছরের পর বছর এসব ক্লাবে জুয়া ও মাদক ব্যবসা চলে আসছিল। সাধারণ মানুষের অভিযোগ, মতিঝিলের ক্লাবগুলো চলত পুলিশের পাহারায়। রাতের বেলা জুয়ার আসরের সামনে পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকত। তবে গতকাল এসব ক্লাবে তালা ঝুলতে দেখা যায়।

পুলিশ পাহারায় জুয়ার ক্লাব চালানো নিয়ে কথা বলতে মতিঝিল থানায় গেলে থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনির হোসেন মোল্লা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাবের পাশের এক চা-দোকানি প্রথম আলোকে বলেন, এই ক্লাব ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকত। দলে দলে মানুষ আসত এখানে। স্থানীয় দুই বাসিন্দা বলেন, বুধবার রাতে র‍্যাবের অভিযানের পরপরই ক্লাবে তালা মেরে পালিয়েছেন আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতারা। তাঁরা জানান, আগে ক্লাবের সামনে দাঁড়াতে গেলে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হতো।

আরামবাগের বাসিন্দা শামসুর রহমান বলেন, তাঁর এক আত্মীয় আরামবাগ ক্লাবে জুয়া খেলে সব টাকা খোয়ান। এ নিয়ে ঝগড়াঝাঁটির পর ওই আত্মীয়ের স্ত্রী একমাত্র সন্তানকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যান।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, তালিকাভুক্ত ক্লাবগুলোর মধ্যে মতিঝিলের ব্রাদার্স ক্লাব চালান ঢাকা মহানগর দক্ষিণের একজন শীর্ষ নেতা, আরামবাগ ক্লাব ও মেরিনার্স ক্লাব চালান যুবলীগের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক, ফকিরেরপুল ক্লাব চালান মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতা, মিরপুরে ঈদগাহ মাঠসংলগ্ন সৈনিক ক্লাব চালান ঢাকা মহানগর উত্তরের ৯৩ নম্বর ওয়ার্ডের একজন শীর্ষ নেতা, রূপনগরের দুয়ারীপাড়ায় জুয়ার ক্লাব চালান স্থানীয় আওয়ামী লীগের একজন নেতা এবং যুবলীগের নেতা সারোয়ার হোসেন উত্তরার কামারপাড়ায় জুয়ার ক্লাব চালান। এ ছাড়া উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের থানার পাশে একটি ক্লাব এবং উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরে গাজীপুর নামের একটি ক্লাবে জুয়ার আসর বসে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেন।

রাজধানীর চারটি ক্যাসিনোতে গত বুধবার অভিযান চালানো হয়। ছবি: প্রথম আলো
রাজধানীর চারটি ক্যাসিনোতে গত বুধবার অভিযান চালানো হয়। ছবি: প্রথম আলো

এদিকে মিরপুর ১ নম্বরের বাগদাদ শপিং কমপ্লেক্সের একটি ব্যায়ামাগারকে জুয়ার ক্লাব বানিয়ে নিয়েছেন স্থানীয় নেতা–কর্মীরা। রেডিয়েল প্যালেস নামের বনানীর একটি ক্লাব কিছুদিন আগে পুলিশ বন্ধ করে দেয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে গুলশান, উত্তরা ও মতিঝিল এলাকায় গড়ে ওঠা ক্লাবগুলোর সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তাদের যোগসাজশ আছে। এসব ক্লাবে যেমন পুলিশি পাহারা থাকত, তেমনি ক্লাবে কোনো বিরোধ হলে তা পুলিশই মেটাত। অনেক পুলিশ সদস্যের নিয়মিত যাতায়াত ছিল এসব ক্লাবে। অনেকে এটাকে পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের ‘যৌথ ব্যবসা’ বলেই মনে করতেন।

মামলা, রিমান্ড

যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ইয়ংমেনস ক্লাবের সভাপতি খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদকদ্রব্য ও মানি লন্ডারিং আইনে গুলশান থানায় তিনটি মামলা করেছে র‍্যাব। আদালত সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। এ ছাড়া ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের আটক তিন কর্মচারীর বিরুদ্ধে গতকাল র‍্যাব মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করেছে।

র‍্যাব জানায়, ওয়ান্ডারার্স ক্লাব চালাতেন ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মমিনুল হক। মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবটি চালাতেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ ও শাহবাগ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আলী আহম্মেদ। এ ব্যাপারে জানতে চেয়ে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে কেউ কথা বলতে রাজি হননি।

র‍্যাব সদর দপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ইয়ংমেনস ক্লাবে অভিযানের সময় পালিয়ে যাওয়া নেপালিকে আটক করা যায়নি। এখন বিভিন্ন ক্যাসিনোতে কর্মরত নেপালি কয়েকজন নারীকে আনা হয়েছে। তাঁদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে এরপর ক্যাসিনোতে আবার অভিযান চালানো হবে।

 মদ বিক্রি বা পানের মতো ক্যাসিনোর অনুমোদন বা লাইসেন্স দেওয়ার কোনো বিধান বা সুযোগই বাংলাদেশের কোনো আইনে নেই। জুয়ার বিষয়ে যে আইনটি কার্যকর আছে, সেটি হলো ‘প্রকাশ্য জুয়া আইন ১৮৬৭’। সেখানে অবশ্য ক্যাসিনো শব্দটির কোনো উল্লেখ নেই।