শূন্য থেকে 'স্বপ্নচূড়া'য়

দেড় দশক আগেও চাঁদমুহা হরিপুর ছিল দারিদ্র্যপীড়িত এক অজপাড়াগাঁ। ফেরি করে মুড়ি-মুড়কি বেচত লোকে। কেউ দিনমজুরি করত। সংসারে অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। অর্ধাহারে দিন কাটত তাদের। সময় এখন বদলেছে। পাল্টেছে গ্রামের চিত্র। কুঁড়েঘরের বদলে উঠেছে পাকা বাড়ি। মাটির চুলার বদলে রান্না হয় গ্যাসের চুলায়। ছোট গ্রামের বড় এই বদলের পেছনে আছে একটি কারখানা, যেখানে কাজ করে মানুষজন আজ সচ্ছল, স্বাবলম্বী। এই কারখানার পেছনে আছে উদ্যমী এক মানুষের গল্প, যিনি একক চেষ্টা ও পরিশ্রমে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন কারখানাটি। ঘুরিয়ে দিয়েছেন হরিপুরের অর্থনীতির চাকা।

সংগ্রামী এ মানুষটির নাম রনজিৎ কুমার পালিত। রাহুল গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান তিনি। শূন্য থেকে সফল উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা ৫৪ বছর বয়সী রনজিতের শৈশবের গল্পটা ছিল কষ্ট আর সংগ্রামের।

সততাই বল

অভাবের সংসারে প্রাথমিকের গণ্ডি পার হতে পারেননি রনজিৎ। কিশোর বয়সেই ফেরি করে বেড়াতেন। বাকিতে পণ্য কিনে গ্রামগঞ্জ, হাটবাজার ঘুরে মুড়ি, মুড়কি, মোয়া, নিমকি, জিলাপি, কদমা-বাতাসা, সন্দেশ বেচতেন। মেলায় দোকান দিতে গিয়ে বৃষ্টিতে মিঠাই ভিজে নষ্ট হয়েছিল একবার। পুঁজি হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। ঋণ শোধ করতে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসেন। ৩০ টাকা বেতনে কাজ নেন বগুড়া শহরের একটি মুদিদোকানে। সেটা বছর চল্লিশেক আগের কথা।

দোকানে কাজ করার সুবাদেই শহরের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। রনজিতের আচার-ব্যবহার ও সততায় মুগ্ধ হন সেই ব্যবসায়ী। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য রনজিৎকে দেড় লাখ টাকা ধার দেন। নিজের কাছে জমানো ছিল ৫৬ হাজার টাকা। সেই টাকা যোগ করে ১৯৯৬ সালে একটি মুদিদোকান দেন।

মনিহারি পণ্য বিক্রির পাশাপাশি সিরাজগঞ্জ থেকে উৎকৃষ্ট মানের সরিষার তেল এনে পলিব্যাগে ভরে বাজারজাত করা শুরু করেন রনজিৎ। সারা দিন দোকানে বেচা–বিক্রি শেষে বাসায় ফিরে রাতভর স্ত্রীকে নিয়ে সরিষার তেল প্যাকেটজাত করতেন। ঘণ্টাকয় ঘুমিয়ে সকালে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। আর দোকানে দোকানে ঘুরে প্যাকেটজাত তেল বেচতেন। অল্প সময়ে জনপ্রিয় হয়ে যায় রনজিতের প্যাকেটজাত তেল। দিন দিন চাহিদা বাড়ে। স্বপ্ন বুনতে থাকেন রনজিৎ, একদিন বড় কারখানা হবে।

হয়েও যায় সেই কারখানা। ২০০৬ সালের কথা। অল্প টাকায় নিজ গ্রামে কিছু জমি কিনে সরিষা ভাঙার কল দেন। রনজিতের দিনবদলের গল্পটা এখান থেকেই শুরু। ছোট্ট একটি সরিষার কল এখন বড় কারখানা। নাম রাহুল ফুড প্রোডাক্ট লিমিটেড।

দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে রাহুল কুমার পালিতের নামেই রেখেছেন কোম্পানির নাম। নিজে পড়াশোনা করতে পারেননি। কিন্তু ছেলে দুটিকে উচ্চশিক্ষিত করতে কোনো কার্পণ্য নেই তাঁর। দুজনই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। শহরের ঘিঞ্জি এলাকায় ১৫০ টাকার ভাড়া বাসায় একসময় থেকেছেন। এখন থাকেন শহরের অভিজাত এলাকায় নিজস্ব বহুতল ভবনে। আছে আবাসন ব্যবসা। রাহুল গ্রুপে সব মিলিয়ে বিনিয়োগ এখন অর্ধশত কোটি টাকা।

এত টাকাপয়সার পরও মোহে জড়াননি রনজিৎ। ভুলে যাননি তাঁর ফেলে আসা অতীত। অসহায়, গরিব–দুঃখীদের তিনি সাধ্যমতো সহায়তা করেন। নানা সামাজিক কাজের পাশাপাশি কারখানাটিকে তিনি শ্রমিকবান্ধব কারখানা হিসেবে গড়ে তুলেছেন।

রাহুল গ্রুপের চেয়ারম্যান রনজিৎ কুমার পালিত। গত মঙ্গলবার বগুড়া সদরের চাঁদমুহা হরিপুর গ্রামে।  ছবি: সোয়েল রানা
রাহুল গ্রুপের চেয়ারম্যান রনজিৎ কুমার পালিত। গত মঙ্গলবার বগুড়া সদরের চাঁদমুহা হরিপুর গ্রামে। ছবি: সোয়েল রানা

মালিক–শ্রমিক অনন্য সম্প্রীতি

বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দূরে বাংলার বিলুপ্ত রাজধানী পুণ্ড্রনগরের পাশেই হরিপুর গ্রাম। সম্প্রতি কথা হয় অর্ধশত শ্রমিকের সঙ্গে। তাঁরা জানান, এখানে মালিক-শ্রমিকের মধ্যে সম্পর্কটাই অন্য রকম। নারী শ্রমিকদের রয়েছে তিন মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি। রয়েছে অসুস্থাজনিত ছুটি। দুর্ঘটনার জন্য রয়েছে ঝুঁকিভাতা, চিকিৎসা ও ওষুধ খরচ সহায়তা। কারখানার দোতলায় মুসলিমদের জন্য রয়েছে নামাজঘর। অন্য পাশে হিন্দুদের জন্য আছে মন্দির।

কারখানার শ্রমিক রেশমা বেগম বলেন, ‘এখানে কাজ করার আগে বাড়িতে উপোস থাকতে হতো। এখন দিনে ২৫০ টাকা রোজগার করি। কারখানায় কাজ করার আয়ে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। ছেলেও কারখানায় কাজ করছে। এখানে কাজ করতে এসে কখনো কারখানা মনে হয় না। মনে হয় পরিবারের সঙ্গেই আছি।’ রেশমা জানান, উৎসব–পরবে বেতনের বাইরে বাড়তি সহায়তা দেওয়া হয়। কারখানাতেই বনভোজনের আয়োজন করা হয়। দুই মাস পরপর উন্নত খাবার দেওয়া হয়।

জোবেদা বেগম নামের আরেক শ্রমিক বললেন, এখানে কেউ অসুস্থ হলে মালিকপক্ষ সবেতনে ছুটি দেন। নারীরা মাতৃত্বকালীন ছুটি নিতে পারেন।

রাহুল ফুড প্রোডাক্ট লিমিটেডে প্রায় ৫০০ শ্রমিক কাজ করেন। এর অর্ধেকই নারী। এ ছাড়া বিপণন বিভাগে কর্মী রয়েছেন প্রায় ২০০। কাঁচামাল সংগ্রহ, পরিবহন, মালামাল ওঠানো–নামানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধাপে কর্মসংস্থান হয়েছে আরও ৩০০ কর্মীর। সব মিলিয়ে এক হাজার কর্মী কাজ করছেন রাহুল গ্রুপে। বর্তমানে রাহুল ব্র্যান্ডের পাঁচ ধরনের বোতলজাত সরিষার তেল, প্যাকেট আটা, ময়দা, লাল আটা, সুজি, চিকন সেমাই, ইউ সেমাই, চুটকি সেমাই, চিনিগুঁড়া চাল, মসুর ডাল, মুড়ি, কয়েক ধরনের পাঁপড় তৈরি হচ্ছে। রাহুলের পণ্য উত্তরের ১৬ জেলা, দক্ষিণাঞ্চলসহ জামালপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, সাভার, উত্তরা, আশুলিয়া, ঢাকা ও কক্সবাজারে যাচ্ছে। সরিষার তেল, মুড়ি ও সুজি মধ্যপ্রাচ্যেও রপ্তানি হচ্ছে।

সামাজিক কর্মকাণ্ড

ব্যবসার পাশাপাশি নানা সামাজিক কাজ করে প্রশংসা কুড়াচ্ছেন রনজিত। হরিপুরের অর্ধশত পরিবারকে কার্ড করে দিয়েছেন। কার্ডধারী পরিবারগুলো প্রতি মাসে চাল, আটা, তেল, চিকিৎসা ভাতা পায়। নিজে পড়াশোনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলেও এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়াতে হতদরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রতিবছর শিক্ষাবৃত্তি দেন। নিজ এলাকায় অত্যাধুনিক একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ারও উদ্যোগ নিয়েছে রাহুল গ্রুপ।

স্বপ্নচূড়া রিয়াল এস্টেট

ভোগ্যপণ্য উৎপাদন ও বিপণন ব্যবসার পাশাপাশি আবাসন ব্যবসায়ও বিনিয়োগ করেছেন রনজিৎ। নাম দিয়েছেন স্বপ্নচূড়া রিয়েল এস্টেট কোম্পানি। তিনি এর চেয়ারম্যান। কথায় কথায় রনজিৎ বললেন, ‘২০০১ সাল থেকে কয়েকজন বন্ধু মিলে ৬০০ টাকা করে সঞ্চয় জমা করতাম। কিছুদিন পর মাসে দুই হাজার টাকা করে রাখতাম। ১২ বছর ধরে জমানো টাকার সঙ্গে আরও লগ্নি দিয়ে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা শুরু করেছি।’

বিশিষ্টজনেরা যা বলেন

হরিপুর গ্রামের বদলে যাওয়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা ও গোকুল ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আলী রেজা বলেন, কারখানা বদলে দিয়েছে এলাকার আর্থসামাজিক চিত্র। অভাবের কারণে গ্রামের অধিকাংশ মানুষের আগে তিন বেলা ভাত জুটত না। কারখানায় কাজ করে এখন সচ্ছল ও স্বাবলম্বী।

বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী শ্যামলী হোটেল অ্যান্ড কনফেকশনারির মালিক হাবিবুল হক বলেন, রনজিৎ অত্যন্ত সৎ, পরিশ্রমী, বিনয়ী ও ভদ্র স্বভাবের মানুষ। সততা ও পরিশ্রম দিয়ে ব্যবসা করে আশাতীত সাফল্য অর্জন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। শূন্য থেকে কোটিপতি হলেও এখনো অতীত ভুলে যাননি। 

রাহুল গ্রুপের প্রশংসা করে বগুড়া শিল্প ও বণিক সমিতির সহসভাপতি মাহফুজুল ইসলাম বললেন, সততা ও কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে ব্যবসা করেও সাফল্যের শিখরে ওঠা যায়, শূন্য থেকে সফল উদ্যোক্তা হওয়া যায়, সেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন রনজিৎ কুমার পালিত।