ক্যাসিনোমালিক-টেন্ডারবাজদের সম্পদের খোঁজে দুদক

ক্যাসিনো ব্যবসায় জড়িত রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ ও তাঁদের পৃষ্ঠপোষকদের সম্পদের খোঁজে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাঁদের সহযোগী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতিরও খোঁজখবর নেওয়া শুরু হয়েছে।

দুদক জানিয়েছে, সম্প্রতি ক্যাসিনো ব্যবসা, চাঁদাবাজি এবং টেন্ডারবাজির সঙ্গে জড়িত ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। উদ্ধার হচ্ছে বিপুল অর্থ। গণমাধ্যমে নানা তথ্য উঠে আসছে তাঁদের এবং পৃষ্ঠপোষকদের সম্পর্কে। সরকারি অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামও উঠে আসছে এই অভিযানে। তাঁদের মধ্যে বেসরকারি ব্যক্তিদের দুর্নীতির অনুসন্ধানের বিষয়টি দুদকের তফসিলভুক্ত নয়। তাই এ বিষয়ে তারা কিছুই করতে পারবে না। কিন্তু তাঁদের সম্পদের বিষয়টি দুদকের অনুসন্ধানের আওতাধীন। অন্যদিকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি ও সম্পদের বিষয়টি দুদক অনুসন্ধান করতে পারে।

সূত্র জানিয়েছে, গত ১৫ দিনে গণমাধ্যমে আসা সব তথ্য সংগ্রহ করেছে দুদক। একই সঙ্গে ওই সব বিষয়ে গোয়েন্দা তৎপরতাও শুরু হয়েছে। গণমাধ্যমে আসা তথ্য ও গোয়েন্দা তথ্য মিলিয়ে ইতিমধ্যে একটি তালিকা করা হয়েছে। সেই তালিকা ধরে শিগগিরই অনুসন্ধানে নামবে সংস্থাটি। কমিশনের বৈঠকের পর আগামী সপ্তাহ নাগাদ অনুসন্ধান দল গঠনের সিদ্ধান্ত আসতে পারে।

দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ আজ বুধবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, কমিশন নিয়মিতভাবেই গণমাধ্যমে আসা তথ্য সংরক্ষণ ও পর্যালোচনা করে। সাম্প্রতিক সময়ে যা ঘটেছে, তা কমিশনের নজরে আছে। এতে কমিশনের তফসিলভুক্ত যেকোনো অপরাধ থাকলে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, আমরা সচেতনভাবেই বিষয়গুলো পর্যালোচনা করছি। অবৈধ সম্পদের যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো দেখছি। পাশাপাশি আমাদের নিজস্ব গোয়েন্দা ইউনিটও তথ্য সংগ্রহ করছে। সেগুলো পর্যালোচনা করেই দ্রুতই আনুষ্ঠানিকভাবে অনুসন্ধানে নামব আমরা।

কমিশনের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ক্যাসিনো বা টেন্ডারবাজি দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধ নয়। এসবের বিরুদ্ধে পুলিশ ও র্যাব অভিযান চালাচ্ছে ও মামলা করছে। তারা তাদের মতো আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছে। এখানে দুদকের করণীয় কিছু নেই। তবে অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদের বিষয়টি অবশ্যই দুদক দেখবে। ইতিমধ্যেই অনুসন্ধান করার মতো যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। আগামী ২ অক্টোবর কমিশনের বিশেষ বৈঠক আছে। সেখান থেকেই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসতে পারে।

বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় ১৪ সেপ্টেম্বর। তাঁদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, কমিটি-বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ, তাঁরা বিভিন্ন কাজে কমিশন নিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছেন। আয়ের উৎস না থাকলেও গাড়ি ও ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ।

১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চলে। অভিযানের প্রথম দিনেই অবৈধ জুয়া ও ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার হন ঢাকা দক্ষিণ মহানগর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। এরপর রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ক্যাসিনো ও জুয়াবিরোধী অভিযানে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা আটক হন সাঁড়াশি অভিযানে। বেরিয়ে আসে নানা পর্যায়ের নেতার নাম।
এই অভিযানের ধারাবাহিকতায় যুবলীগের ঢাকা দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাটসহ অনেকের নাম উঠে আসে।

২০ সেপ্টেম্বর র‍্যাবের হাতে আটক হন ঠিকাদার ও যুবলীগ নেতা জি কে শামীম। বিপুল অর্থ উদ্ধার করা হয় তাঁর অফিস থেকে। হাজার হাজার কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নেওয়া জি কে শামীমের সঙ্গে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির সম্পৃক্ততার তথ্য আসে গণমাধ্যমে।

ইতিমধ্যেই এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে। তদন্তের জন্য গোয়েন্দা নজরদারিতে আছেন অনেকেই। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাংসদ নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন এবং যুবলীগের নেতা ইসমাইল হোসেনের ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে। এ ছাড়া আটক যুবলীগের নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, কৃষক লীগের নেতা শফিকুল আলম ওরফে ফিরোজ ও রিমান্ডে থাকা যুবলীগের নেতা জি কে শামীমের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে তাঁদের স্ত্রী, মা বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট অন্য যেকোনো নামে হিসাব থাকলে তাও স্থগিত করা হয়েছে। অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইনের আওতায় এসব হিসাব ৩০ দিনের জন্য স্থগিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঘুষ লেনদেনের তথ্য থাকায় গণপূর্তের সাবেক দুই প্রকৌশলীর ব্যাংক হিসাবও চেয়েছে এনবিআর।

দুর্নীতিসহ অপরাধের বিভিন্ন তথ্য থাকায় ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরীসহ ১৪ নেতার বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ইসমাইল হোসেন চৌধুরী কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক ও বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন বলেও অভিযোগ আছে।

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর তদন্তে নেমে গোয়েন্দারা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী, খালেদ মাহমুদ, কাউন্সিলর আবু সাঈদসহ যুবলীগের থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের লোকজন এই ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এখন পর্যন্ত মোট ১২৮ জনের নাম পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে।

দুদক সূত্র জানিয়েছে, সংশ্লিষ্ট সবার বিরুদ্ধে দুদকের তফসিলে থাকা অপরাধের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে মাঠে নামবে তারা। কোনো ক্ষেত্রেই ছাড় দেওয়া হবে না।