নতুন করে আলোচনায় শোকরানা

মোহাম্মদ শোকরানা। ফাইল ছবি
মোহাম্মদ শোকরানা। ফাইল ছবি

বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য, আলোচিত ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শোকরানার দলত্যাগের বিষয়টি বগুড়ার আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ছাত্রলীগ ও যুবলীগ দিয়ে রাজনীতি শুরু করা মোহাম্মদ শোকরানা ৫০ বছরের রাজনৈতিক অধ্যায়ের ইতি টেনে গত সোমবার বিএনপির মহাসচিবের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে আলোচনায় আসেন।

শোকরানা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। পদত্যাগের পর তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কারও প্রতি কোনো ক্ষোভ বা অভিযোগ থেকে নয়; পরিবারকে সময় দেওয়ার জন্যই তিনি রাজনীতি ছাড়ছেন। রাজনীতি করার ইচ্ছে আর নেই।

বগুড়া-১ (সোনাতলা-সারিয়াকান্দি) আসন থেকে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন পেয়ে আওয়ামী লীগের আবদুল মান্নানের কাছে পরাজিত হন। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন চান। কিন্তু মনোনয়ন পান কাজী রফিকুল ইসলাম। ১৭ সেপ্টেম্বর শোকরানার সম্পদের হিসাব চেয়ে চিঠি দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের নোটিশ পাঠানোর পাঁচ দিনের মাথায় শোকরানা দল থেকে পদত্যাগ করেন।

জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সাইফুল ইসলাম বলেন, মোহাম্মদ শোকরানা ২০ বছর ধরে দলে অর্থ ও শ্রম দিয়েছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ষড়যন্ত্র করে তাঁকে হারিয়ে দেওয়া হয়। তবু তিনি হতাশ হননি। সাইফুল ইসলাম আরও বলেন, ২০১২ সালের পর বগুড়া বিএনপি এক ভয়ংকর সময় অতিবাহিত করেছে। নেতাদের ওপর হাজার হাজার হামলা, গুলি চালানো হয়েছে। দলীয় কার্যালয় খুলতে দেওয়া হয়নি। মিছিল–সভা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শোকরানা প্রশাসন ও সরকারের ভয়ভীতি উপেক্ষা করে দলের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের হোটেলে রেখে সেখানে দলীয় সভা-সমাবেশ করতে দিয়েছেন। সেই অর্থে দল থেকে তিনি কিছুই পাননি। 

জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, শোকরানা নানাভাবে এত দিন বগুড়া বিএনপির পাশে থেকেছেন, এটা সত্য। তবে তাঁর পদত্যাগে দলের কোনো ক্ষতি হবে না। কারণ, বগুড়া এখনো বিএনপির ঘাঁটি। ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে মনোনয়ন না পাওয়ার হতাশা এবং দুদকের চিঠি পেয়ে ভীত হয়ে শোকরানা বিএনপি ছাড়ছেন বলেও মন্তব্য করেন এই নেতা।

জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ বলেন, শোকরানা দেড় দশক ধরে অর্থ ও শ্রম দিয়ে বিএনপিকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন, এটা সত্য। সেই অর্থে দলে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তবে দল থেকে পদত্যাগের বিষয়টি তাঁর ব্যক্তিগত। কারণ, বিএনপি বৃহৎ দল। যে কেউ দল থেকে পদত্যাগ করতে পারেন, এতে দলের কিছু যায় আসে না।

শোকরানার দল ছাড়ার বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করেন বিএনপির রাজশাহী বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার। তিনি বলেন, দলের দুঃসময়ে তিনি বগুড়া বিএনপিকে ছায়ার মতো আগলে রেখেছেন। সামনে সুদিন আসছে। এমন সময়ে তাঁর মতো নেতা দল ছাড়ায় তিনি কষ্ট পেয়েছেন। 

মোহাম্মদ শোকরানার রাজনৈতিক অধ্যায় শুরু হয় ১৯৬৭ সালে ছাত্রলীগের মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনীর বগুড়া শাখার কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করা শোকরানার বিরুদ্ধে ১৯৭২ থেকে ৭৫ পর্যন্ত যুবলীগের ছত্রচ্ছায়ায় খুন-হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। একটি হত্যা মামলায় তিনি সোয়া ছয় বছর জেলও খেটেছেন। 

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯৮১ সালে শোকরানা সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি পান। কিছুদিন নিষ্ক্রিয় থাকার পর এরশাদের হাত ধরে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। তবে শোকরানা জাতীয় পার্টিতে যোগদানের কথা অস্বীকার করেন। ১৯৯৯ সালে তারেক রহমানের হাত ধরে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। ২০০৭ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ডাল কেলেঙ্কারি ও ত্রাণের কম্বল মজুত করার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়। তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিশেষ ক্ষমতা আইনে শোকরানা ও তাঁর সহযোগী পরিমল কুমার সিংয়ের বিরুদ্ধে বগুড়া সদর থানায় মামলা হয়। মামলার বিচারও শুরু হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১১ সালের ২১ নভেম্বর ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ বিবেচনায় মামলাটি প্রত্যাহার করা হয়। 

শোকরানা প্রথম আলোকে বলেন, মাহতাব হত্যা মামলায় আদালত তাঁকে মুক্তি দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল। ওই সময়ে তাঁর নেতৃত্বে একটি বাহিনী ছিল। তাদের কর্মকাণ্ডের কারণে তাঁর বদনাম হয়েছে। মামলায় জড়ানো হয়েছে। তবে কোনো হত্যা, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন না। সবই অভিযোগ। কেউ কোনো প্রমাণ দিতে পারবে না।