কী আছে কুমিল্লার ময়নামতিতে

শালবন বিহার ময়নামতির প্রত্নতাত্ত্বিক খননস্থানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল। ছবি: দীপু মালাকার
শালবন বিহার ময়নামতির প্রত্নতাত্ত্বিক খননস্থানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল। ছবি: দীপু মালাকার

মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় বিস্ময় মানুষ নিজে। নিজেরই সৃষ্টির দিকে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সময়ের আবরণে ঢাকা পড়ে গেলে নিজের অতীতের দিকে তাকিয়ে তাকে আর চেনা যায় না। অতীতের জীবন বদ্ধ, অনড়, স্তূপ হয়ে পড়ে থাকে। তার পাশে বয়ে যায় জীবন্ত প্রাণের স্রোত।

জনাকীর্ণ কুমিল্লা শহর থেকে প্রায় আট মাইল দূরে এগিয়ে যান। যাবেন ময়নামতি অঞ্চলে। নিচু পাহাড়ি এক এলাকাকে এই নামেই ডাকা হয়। মেঘনা অববাহিকার বিস্তীর্ণ উর্বর নিচু সমতল ভূমির মধ্যে এই উঁচু অঞ্চল। পাশে সাড়ে চার কিলোমিটার। এর সর্বোচ্চ উচ্চতা ৪৫ মিটার। একসময় ছিল ঘন অরণ্যে ঢাকা। বিখ্যাত ছিল দুর্লভ ঔষধির জন্য। প্রাচীন রাজারা একে বলতেন ‘লালম্বি বন’। এখানকার ভূপ্রকৃতিও ঠিক পাললিক নয়। মাটি লালচে। একসময় এখানে ছিল শালের বন।

এখানকার অনেক বিহারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত শালবন বিহার। ময়নামতি অঞ্চলে গেলে অধিকাংশ মানুষ এটাই দেখতে যায় প্রথম। সপ্তম শতাব্দীর এই বৌদ্ধবিহারে ছাত্ররা পড়ালেখা করেছে ১৩০০ সাল পর্যন্ত। এটি ছিল আবাসিক শিক্ষায়তন। শিক্ষার্থীদের থাকার জন্য ছিল ১১৫টি কক্ষ। এর আসল নাম ছিল ভবদেব বিহার।

চারদিকে অরণ্য, মাঝখানে নির্জন এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে অধ্যয়ন করত। রাজা বিহারের ব্যয় নির্বাহের জন্য গ্রাম দান করতেন। এর রাজস্ব থেকেই বিহারের সব খরচ উঠে আসত। শিক্ষা ছিল মেধানির্ভর। কেবল যোগ্য শিক্ষার্থীরা সেখানে বিনা খরচে পড়ার সুযোগ পেত। আমাদের অঞ্চলে প্রাচীনকালে এই ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শ। ছাত্র যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুঁজত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও তেমনি খুঁজে বেড়াত মেধাবী ছাত্র।

এ রকম বিহার কুমিল্লার ময়নামতি অঞ্চলে ছিল একাধিক। তার সামান্য অংশই খনন করা হয়েছে। বিশাল অংশ রয়ে গেছে মাটির তলায়। যা এর মধ্যে খনন করে লোকচক্ষুর সামনে আনা হয়েছে, সেগুলোও অনেক—কোটিলা মুড়া, চারপত্র মুড়া, ভোজ বিহার, রূপবান মুড়া, ইটাখোলা মুড়া ইত্যাদি।

আজকের কুমিল্লা অঞ্চল প্রাচীন সমতটের অংশ। সমতট মানে তটের সমান। সমুদ্রের পৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা বেশি ছিল না বলেই এর এই নাম। ময়নামতি অঞ্চল সেই তুলনায় উঁচু ভূমি। এখানে গড়ে উঠেছিল সুবিশাল এক শিক্ষাকেন্দ্র। আজ থেকে প্রায় ১৩০০ বছর আগে এর যাত্রা শুরু। ষষ্ঠ থেকে ১২০০ শতাব্দী পর্যন্ত এই পুরো অঞ্চল ছিল বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। সারা ভারতের বৌদ্ধ সংস্কৃতির সর্বশেষ শিখা জ্বলেছিল এখানে।

জনাকীর্ণ কুমিল্লা শহর থেকে প্রায় আট মাইল দূরে এগিয়ে গেলে পাওয়া যাবে ময়নামতি অঞ্চল। ছবি: দীপু মালাকার
জনাকীর্ণ কুমিল্লা শহর থেকে প্রায় আট মাইল দূরে এগিয়ে গেলে পাওয়া যাবে ময়নামতি অঞ্চল। ছবি: দীপু মালাকার

আজকের মিয়ানমারে বৌদ্ধ দর্শন ছড়িয়ে দিয়েছেন এই অঞ্চলের বৌদ্ধবিহারের পণ্ডিতেরা। সুদূর কাশ্মীর, ইরান, মধ্য এশিয়া থেকে বিদ্যার্থীরা জ্ঞান অন্বেষণে এসে হাজির হতেন কুমিল্লার এসব বিদ্যাপীঠে। এখানকার পণ্ডিতদের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল চীন পর্যন্ত। সপ্তম শতাব্দীতে সুদূর চীন থেকে এসেছিলেন হিউয়েন সাং, এই কুমিল্লার লালমাইয়ের কোনো এক বৌদ্ধবিহারে।

এই বিশাল সভ্যতার সব চিহ্ন চাপা পড়েছিল মাটির তলায়। মানুষ ভুলে গিয়েছিল এদের কথা। উঁচু হয়ে থাকা মাটিচাপা বিহারগুলোকে আঞ্চলিকভাবে ডাকা হতো মুড়া বলে। মুড়া মানে উঁচু জায়গা বা টিলা। ১৮০৩ সালে প্রথম এই অঞ্চলের ভিন্ন ইতিহাসের চিহ্ন পাওয়া যায়। ১২২০ সালের এক তামার লিপি থেকে জানা যায় জাঁকজমকে পূর্ণ পট্টিকেরা নামের রাজনগরীর কথা। সেই নগরীর চিহ্ন কোথায়, এখন কেউ জানে না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কুমিল্লা অঞ্চল হয়ে উঠল মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে জাপানি আক্রমণ আটকানোর গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। সৈনিকদের বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করতে গিয়ে আবিষ্কার হলো বিশাল সব প্রাচীন স্থাপনা। ময়নামতি অঞ্চলের বৌদ্ধ সভ্যতার অবশেষ বিস্মিত করল সবাইকে। তৎক্ষণাৎ জরিপ করে ১৮টি স্থাপনা চিহ্নিত করা হয়েছিল। পরে ১৯৫৫ ও ১৯৫৭ সালে জরিপ করে ৫০টির বেশি স্থাপনা বের করা হয়।

এখনো এই অঞ্চলের সম্পূর্ণ খনন করা হয়নি। অনেক কিছু চলে গেছে বর্তমানের নতুন স্থাপনার নিচে। অনেক জায়গা অবহেলায় পড়ে আছে। কিন্তু যা পাওয়া গেল, তাতেই বোঝা গেছে এই অঞ্চলের এক অজানা ইতিহাসের পর্ব আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, যার সম্পর্ক বিশ্বের ইতিহাসের সঙ্গে। বিভিন্ন রাজার তামার ফলকে লেখা দানপত্র তুলে এনেছে এমন সব স্থান আর ঘটনার কথা, যা ইতিহাসকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করাচ্ছে।