কঠিন বাস্তবতায় কিশোরীটি

বাল্যবিবাহ ও স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার এক কিশোরীকে নিয়ে বিপাকে পড়েছে তার পরিবার। কিশোরী বর্তমানে সন্তানসম্ভবা। গ্রামের মাতবরেরা তার সন্তান প্রসবের পর নির্যাতনের বিচারসহ সমস্যাটি সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন। স্বামীর বাড়ি থেকে বিতাড়িত কিশোরী এখন বাবার বাড়িতে আছে।

ঘটনাটি নান্দাইল উপজেলার গাংগাইল ইউনিয়নের সুরাশ্রম গ্রামের। গতকাল শুক্রবার ওই গ্রামে গেলে কিশোরীর পরিবারের সদস্যরা জানান, মেয়েটির বর্তমানে বয়স ১৬ বছর। ২০১৮ সালের জুনে সুরাশ্রম গ্রামের মৃত শাবান উদ্দিন ছেলে মো. সুমন মিয়ার সঙ্গে তার বিয়ে হয়।

মেয়েটির মা ঢাকায় চাকরি করেন। চাকরিসূত্রে স্বামী-সন্তান নিয়ে তিনি ঢাকায় থাকতেন। ২০১৭ সালে পবিত্র রমজানের ঈদের কয়েক দিন আগে মেয়েকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন তাঁরা। বাড়ি আসার কয়েক দিন পর গ্রামের মৃত শাবান উদ্দিনের ছেলে মো. সুমন মিয়া মেয়েটির সম্মান নষ্টের চেষ্টা চালান। খবর পেয়ে মেয়েটির মা-বাবা দ্রুত ঢাকা থেকে বাড়িতে আসেন। মেয়ের কাছে সব শুনে সুমনের পরিবারের কাছে গিয়ে ঘটনার বিচার চান। কিন্তু বিচারের বদলে সুমনের মা তাঁর ছেলের সঙ্গে মেয়েটির বিয়ের প্রস্তাব দেন। এ জন্য গ্রামের কিছু মাতবর ও স্থানীয় কয়েকজন জনপ্রতিনিধিকে দিয়ে চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। কিন্তু ১৮ বছর না হওয়ায় মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি হননি তার মা-বাবা। এরপর সুমনের পরিবার মেয়েটির বয়স ২১ বছরে উন্নীত করে একটি ভুয়া জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরি করে। তখন মেয়ের মানসম্মানের কথা ভেবে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিয়েতে রাজি হন তার মা-বাবা।

ভুক্তভোগী কিশোরীর ভাষ্য, বিয়ের ছয় মাস না পেরোতেই স্বামীর সঙ্গে তার মনোমালিন্য দেখা দেয়। পান থেকে চুন খসলেই স্বামী তাকে নির্যাতন করতে থাকেন। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে সে ঢাকায় মা-বাবার কাছে চলে যায়। সেখানে চার মাস থাকার পরও স্বামী তার খোঁজ নেয়নি। পরে মা-বাবা তাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে শ্বশুরবাড়িতে পাঠান। সম্প্রতি গ্যাসের চুলা নেভানো নিয়ে স্বামী তাকে বেদম মারধর করেন। মারধরের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে স্বামীর হাতে কামড় বসিয়ে দেয় সে। এ ঘটনায় স্বামীর পরিবারের লোকজন ‘বউয়ের’ বিচার করার জন্য ১৮ সেপ্টেম্বর এলাকায় সালিস বসান। সুমন সেই সালিসে স্ত্রীর সঙ্গে সংসার করবেন না বলে জানিয়ে দেন। কিন্তু মেয়েটি সন্তানসম্ভবা হওয়ায় এ বিষয়ে সালিসকারীরা কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেননি। সালিসে উপস্থিত ছিলেন উপজেলার গাংগাইল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সৈয়দ আশরাফুজ্জামানসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা।

গতকাল বাড়িতে গেলে ইউপি চেয়ারম্যান জানান, সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যা মনে করে বিষয়টি সমাধানের জন্য সালিস বসানো হয়েছিল। কিন্তু সুমনের স্ত্রী সন্তানসম্ভবা হওয়ায় সালিস অমীমাংসিত রয়ে গেছে। সন্তান প্রসবের পর বিষয়টি শেষ করে দেওয়া হবে। স্বামীর হাতে নির্যাতনের বিচার পাওয়ার জন্য কিশোরীকে সাত মাস অপেক্ষা করানোর বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি স্পষ্ট করে কিছু বলেননি।

চেয়ারম্যানের সই করা জন্মসনদ ব্যবহার করে কিশোরীর বাল্যবিবাহ সম্পর্কে চেয়ারম্যান আশরাফুজ্জামান দাবি করেন, ১৮ সেপ্টেম্বরের সালিসের সঙ্গে জন্মনিবন্ধন সনদের বিষয়টি প্রাসঙ্গিক ছিল না। তারপরও তিনি সনদটি হাতে নিয়ে সেটি ভুয়া বলে দাবি করেন। যে ব্যক্তি ভুয়া জন্মসনদ জোগাড় করেছেন তিনি তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করবেন।

গাংগাইল ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্রের উদ্যোক্তা মো. জহিরুল হকের কাছে কিশোরীর দুটি জন্মসনদ উপস্থাপন করে কোনটি বৈধ জানতে চাইলে তিনি নিজের সই করা সনদটি ভুয়া বলে জানান। সনদে থাকা স্বাক্ষরও তাঁর নয় বলে দাবি করেন।

প্রকৃত জন্মসনদে কিশোরীর জন্মতারিখ ২০০৩ সালের ১০ আগস্ট। সে হিসেবে তার বর্তমান বয়স ১৬ বছরের কিছু বেশি। জন্মনিবন্ধন–সংক্রান্ত সরকারি ওয়েবসাইট ঘেঁটে এ সনদের সত্যতা পাওয়া গেছে।

ভুয়া জন্মসনদ ব্যবহার করে কিশোরীর বাল্যবিবাহ নিবন্ধন করেছেন গাংগাইল ইউনিয়নের নিকাহ নিবন্ধক (কাজি) মো. মোস্তফা।