নড়াইলের জেলা জজকে দায়রা মামলার বিচার থেকে বিরত রাখা প্রয়োজন: হাইকোর্ট

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

নড়াইলের কালিয়া থানার একটি হত্যা মামলার এজাহারে থাকা প্রধান আসামিকে অভিযোগ গঠনের সময় অব্যাহতি দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নড়াইলের জেলা ও দায়রাকে এক বছরের জন্য দায়রা মামলা পরিচালনা থেকে বিরত রাখতে হাইকোর্টের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে।

বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ২৯ আগস্ট ওই রায় দেন। আজ সোমবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ১২ পৃষ্ঠার ওই রায় প্রকাশিত হয়।

সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে রায়ের অভিমতে আদালত বলেছেন, আমাদের সুচিন্তিত অভিমত এই যে, নড়াইলের জেলা ও দায়রা জজ শেখ আব্দুল আহাদকে এক বছরের জন্য দায়রা মামলা পরিচালনা থেকে বিরত রাখা প্রয়োজন; যাতে করে এ সময়ের জন্য বিচারক দায়রা মামলা পরিচালনার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে পারেন। অভিমত সম্পর্কে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণের জন্য সুপ্রিম কোর্টের কাছে উত্থাপনের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের সচিব ও সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ দেওয়া হলো।

২০১৫ সালে ১০ ফেব্রুয়ারি নড়াইলের কালিয়ার চন্ডিনগর সরকারি প্রাথমিক স্কুলের সামনে বিএল কলেজের মাস্টার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী এনামুল শেখকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় মাঝহারুল ইসলাম ওরফে মাঝাসহ ৬৭ আসামির নাম উল্লেখ করে পরদিন কালিয়া থানায় মামলা করেন নিহতের ভাই নাজমুল হুদা। মাঝাসহ ৬৮ জনের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে অভিযোগপত্র দেয় তদন্ত কর্মকর্তা। ওই মামলায় এজাহার দাখিলের প্রায় তিন বছর ৯ মাস পর গত বছরের ২৯ নভেম্বর নড়াইলের দায়রা জজ আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নেন মাঝা। চলতি বছরের ১০ জুন ওই মামলায় অভিযোগ গঠন করা হয়, তবে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় মাঝাকে। এর বিরুদ্ধে গত ২৭ জুন হাইকোর্টে আবেদন (ফৌজদারি রিভিশান) করেন বাদী।

এর শুনানি নিয়ে গত ৭ জুলাই হাইকোর্ট মাঝাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে গত ১০ জুন বিচারিক আদালতের দেওয়া আদেশ কেন বাতিল ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল দেন। এ ছাড়া অভিযোগ গঠনের সময় অব্যাহতি দেওয়ায় বিচারকের বিচারিক ক্ষমতা কেন প্রত্যাহার করা হবে না—এ বিষয়ে নড়াইলের দায়রা জজ শেখ আব্দুল আহাদকে কারণ দর্শাতে বলা হয়। সেই সঙ্গে মাঝাকে দুই সপ্তাহের মধ্যে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এই নির্দেশ অনুসারে মাঝা গত ৭ জুলাই নড়াইলের দায়রা জজ আদালতে আত্মসমর্পণ করলে দায়রা জজ (ভারপ্রাপ্ত) মাঝাকে জামিন দেন। আগে দেওয়া রুল শুনানিতে এই জামিনের বিষয়টি নজরে এলে হাইকোর্ট গত ৩০ জুলাই স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে রুল দেন। রুলে মাঝাকে দেওয়া জামিন কেন বাতিল করা হবে না, তা জানতে চানতে চাওয়া হয়। এসবের শুনানি শেষে পর্যবেক্ষণ ও অভিমতসহ গত ২৯ আগস্ট ওই রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ে আসামি মাঝাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে নড়াইলের দায়রা জজ আদালতের দেওয়া আদেশ বাতিল করা হয়।

‘অব্যাহতি দিয়ে মারাত্মক ভুল করেছেন’
রায়ে বলা হয়, ফৌজদারি রুল দেওয়ার সময় প্রাথমিকভাবে এই আদালত অভিমত ব্যক্ত করেন যে, তর্কিত আদেশ পর্যালোচনায় প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়েছে যে, নড়াইলের দায়রা জজ এজাহার ও অভিযোগপত্রে আসামির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও, যা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দ্বারা সমর্থিত, আসামি কর্তৃক দাখিল করা আত্মপক্ষ সমর্থনে কৈফিয়তের কাগজাদি/বক্তব্য বিবেচনায় নিয়ে আসামিকে অভিযোগ গঠন পর্যায়ে মামলা হতে অব্যাহতি দিয়েছেন। আসামির আত্মপক্ষ সমর্থনে কৈফিয়তের কাগজাদি বিবেচনায় নিয়ে অভিযোগ গঠন পর্যায়ে আসামিকে মামলা হতে অব্যাহতি দেওয়া কোনোভাবেই আইনসংগত নয় এবং প্রচলিত আইন এবং সুপ্রতিষ্ঠিত আইনি নীতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। একজন দায়রা জজের কাছে এ ধরনের আদেশ প্রত্যাশিত নয়।

রায়ের অভিমতে বলা হয়, দায়রা জজ (নড়াইল জেলা ও দায়রা জজ) আসামির (মাঝা) আত্মপক্ষ সমর্থনে কাগজাদি/বক্তব্য এবং পেশাগত অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে চার্জ গঠন (অভিযোগ গঠন) পর্যায়ে মামলা হতে অব্যাহতি দিয়ে মারাত্মক ভুল করেছেন, যা বেআইনি এবং ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।

অভিমতে হাইকোর্ট বলেছেন, সাময়িকভাবে হলেও নড়াইলের দায়রা জজ আব্দুল আহাদের দায়ের মামলা সংক্রান্ত বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ স্থগিত করা প্রয়োজন।

যান্ত্রিকভাবে অভিযোগ গঠন সমীচীন নয়
বিভিন্ন নজির পর্যালোচনা করে রায়ে বলা হয়, নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করলে এটি প্রতীয়মান হয় যে, এজাহার বা অভিযোগপত্রে আসামির নাম উল্লেখ থাকলেই যেমন যান্ত্রিকভাবে অভিযোগ গঠন করা সমীচীন নয়, তেমনি কোনো আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রাথমিক/আপাত যথার্থতা থাকলে অভিযোগ গঠন পর্যায়ে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। অভিযোগ গঠন পর্যায়ে আসামির বিরুদ্ধে আনা আপাত দৃষ্ট অভিযোগটি সত্য কিংবা মিথ্যা তা নির্ধারণ করার সুযোগ নেই; সেটি নির্ধারণ হবে বিচার প্রক্রিয়ার শেষে উপস্থাপিত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে।

রায়ে বলা হয়, ঘটনার দিন ও সময়ে মাঝহারুল সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে গোপালগঞ্জ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন—তাঁর এই ‘অজুহাত’ বা ‘দাবি’ আইন অনুযায়ী তাঁকেই প্রমাণ করতে হবে। এ ‘অজুহাত’ বা ‘দাবি’ অভিযোগ গঠন পর্যায়ে বিবেচনায় নিয়ে কোনো অভিযুক্তকে মামলা হতে অব্যাহতি দেওয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই।

কারণ দর্শানো ও বিচারকের ক্ষমা প্রার্থনা
হাইকোর্টের কারণ দর্শানোর পরিপ্রেক্ষিতে নড়াইলের দায়রা জজ শেখ আব্দুল আহাদ লিখিত জবাব আদালতে দাখিল করেন। এতে ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ভুল না করার জন্য সতর্ক থাকবেন বলেন তিনি।

এ বিষয়ে রায়ে উচ্চ আদালত বলেছেন, জবাব পড়ে মনে হয়েছে যে, বিচারক অনিচ্ছাকৃতভাবে আইনগত ভুল করেছেন এ ধরনের কোনো আত্মোপলব্ধি বা অনুশোচনার অবস্থান থেকে ক্ষমা চাননি; বরং মনে হচ্ছে যে, যেহেতু হাইকোর্ট বিভাগ ভুল ধরেছে কেবলমাত্র সে কারণেই তিনি ভুল স্বীকার ও ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন।

আদালতে নাজমুল হুদার পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ হোসেন। মাঝার পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী এ এম আমিন উদ্দিন ও রবিউল আলম। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন।

হাইকোর্টের রায়ে দেওয়া পর্যবেক্ষণ ও অভিমতের আলোকে নড়াইলের দায়রা জজকে আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ বিষয়ে আইনজীবী মোহাম্মদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মাঝাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে দেওয়া আদেশ বাতিল করে হাইকোর্ট ওই নির্দেশ দিয়েছেন। এখন মাঝার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন বিষয়ে নিম্ন আদালতে শুনানি হবে।