যে বিদ্যালয় দেখতে ভিড় জমান দর্শনার্থীরা

চাঁদপুরের প্রত্যন্ত গ্রামে ব্যক্তি উদ্যোগে অসচ্ছল পরিবারের শিশুদের লেখাপড়ার জন্য দেশীয় প্রযুক্তিতে দৃষ্টিনন্দন স্থাপনায় নির্মিত শাহাবুদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজটি যেন পর্যটনকেন্দ্রে রূপ নিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এর ছবি ও শিক্ষাকার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ায় এটি দেখতে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিন শত শত মানুষ ভিড় করছেন।

লোকজনের ভিড় দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি বিদ্যালয় ফটকের সামনে নোটিশ বোর্ড টাঙিয়ে সেখানে প্রবেশ সময় নির্ধারণ করে দিয়েছে। বিদ্যালয় চলার সময় (সকাল নয়টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত) দর্শনার্থী প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তারপরও একনজর এটি দেখার জন্য কিংবা একটু ভেতরে গিয়ে ঘুরে ঘুরে ছবি তোলার জন্য সকাল থেকে অপেক্ষা করতে থাকেন বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা দর্শনার্থীরা।

গত শুক্রবার বিকেলে বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, নানা বয়সী দর্শনার্থী এটি দেখতে ভিড় করেছেন। তাঁরা ভেতরে প্রবেশ করে এর ব্যতিক্রমী নকশা আর মনোমুগ্ধকর পরিবেশে ঘুরে ঘুরে ছবি তুলছেন। আবার কেউ কেউ দল বেঁধে আড্ডা এবং বিদ্যালয় নিয়ে আলাপচারিতায় ব্যস্ত। 

কারুকার্যখচিত, দৃষ্টিনন্দন বিদ্যাপীঠ শাহাবুদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। এটি দেখতে আসা চাঁদপুর পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর শাহেদ রায়হান বলেন, ‘স্কুলটি শহর থেকে দূরে লক্ষ্মীপুর গ্রামে অবস্থিত। এখানে যেই পরিবেশ ও পড়ালেখার ব্যবস্থা দেখেছি, এতে মনে হলো জেলা শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে না হলে অনেক ছেলেমেয়ে শহর থেকে এসে এখানে পড়তে চাইত।’

বিদ্যালয়টি দেখতে আসা ঢাকার গুলশান ২ নম্বরের বাসিন্দা ব্যবসায়ী এন এম খান মুরাদ বলেন, ‘একটি গ্রামের ভেতর এত সুন্দর একটি স্কুল হতে পারে, তা কল্পনাও করতে পারিনি। দেশের কোথাও কাঠ, বাঁশ, ইট ও সুরকিতে তৈরি এমন ব্যতিক্রমী স্কুল ভবন দেখিনি। শুনেছি শাহাবুদ্দিন গরিবদের জন্য এই স্কুল করেছেন, যেখানে নদীভাঙনের শিকার, দিনমজুর, জেলে ও কৃষক পরিবারের সন্তানেরা বিনা পয়সায় লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে। আর সেটা বাস্তবে এসে দেখলাম। এটি আসলেই দেশের জন্য দৃষ্টান্ত।’

পরিবার নিয়ে এটি দেখতে আসা ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘এটি দেখতে অসাধারণ। চারদিকের পরিবেশ শান্ত ও নির্মল। বিশেষ করে বাচ্চাদের শিক্ষার জন্য দারুণ এক প্রতিষ্ঠান। এখানকার পরিবেশ দেখে বাচ্চারা পড়াশোনায় আগ্রহ দেখাবে। সব মিলেই খুব ভালো লেগেছে।’

এই বিদ্যালয়ের ছাত্রী মেহেরুন্নেসা বলে, ‘আমি পার্শ্ববর্তী একটি বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতাম। এটি শুরু হওয়ার পর এর সৌর্ন্দয ও লেখাপড়া নিয়মকানুন দেখে এখানে এসে ভর্তি হয়েছি। এখানে ভর্তি হওয়ার পর খুব ভালো লাগছে পড়াশোনা করতে। কারণ, আমাকে শিক্ষক–শিক্ষিকারা সব বিষয় বিদ্যালয়েই রেখে শিখিয়ে দেন। বাড়িতে গিয়ে আর পড়তে হয় না।’

এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, ঢাকার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী চাঁদপুরের কৃতী সন্তান শাহাবুদ্দিন একজন প্রচারবিমুখ মানুষ। তিনি সব সময় সমাজ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করেন, কিন্তু কখনো তা প্রচার করেন না।

বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। শেষ হয় ২০১৭ সালে। এর শিক্ষাকার্যক্রম শুরু হয় ২০১৮ সালে, বই উৎসবের মাধ্যমে। এতে বর্তমানে নার্সারি থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকার্যক্রম চালু রয়েছে। শিক্ষার্থী ১৬৮ জন। শিক্ষক ১২ জন। এটি চাঁদপুর সদর উপজেলা থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামে অবস্থিত। শহর থেকে সেখানে যেতে হয় সিএনজিচালিত কিংবা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায়। চাঁদপুরের তরুণ স্থপতি লুৎফুল্লাহিল মজিদ এবং তাঁর দুই বন্ধু যুবায়ের হাসান ও নবী নেওয়াজ খানের প্রতিষ্ঠান ‘আর্কি গ্রাউন্ড’ দৃষ্টিনন্দন করে এর নকশা করেছেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থায় বিশেষত্ব হলো, এখানকার কয়েকজন শিক্ষক স্কুল শেষে শ্রেণিকক্ষেই দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীকে সব বিষয়ে পড়িয়ে দেন, যাতে বাড়িতে গিয়ে তাদের তেমন পড়তে না হয়।

মাটির রঙে নির্মিত দোতলা বিদ্যালয়টির সঙ্গে সেখানে দেখার মতো একটি মসজিদও রয়েছে। 

প্রধান শিক্ষক শঙ্কর কুমার সাহা বলেন, ‘এটি গ্রামের গরিব শিক্ষার্থীদের জন্য করা হয়। কিন্তু এটির সৌন্দর্য দেখতে প্রতিদিন যে হারে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন আসে, তা সামাল দিতে আমাদের হিমশিত খেতে হয়। এ জন্য দর্শনার্থীদের প্রবেশে সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। তারপরও ভিড় সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে।’

প্রতিষ্ঠাতা শাহাবুদ্দিন বলেন, ‘আমার স্বপ্ন ছিল, নিজ গ্রামে গরিব শিশুদের শিক্ষার সুবিধা নিশ্চিত করতে স্কুল করা। আমি দেখেছি, যারা স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ফল করে, তাদের অধিকাংশই গ্রাম থেকে উঠে আসা। এমন স্কুল করতে পারায় আমি খুশি। এখানকার শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা শেষে নানা ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারবে, এটাই প্রত্যাশা।’