অনলাইন ক্যাসিনোর টাকা পাচার করতেন সেলিম

অনলাইনে ক্যাসিনো ব্যবসার মূল হোতা সেলিম প্রধান। আটকের পর গুলশান-২–এ তাঁর কার্যালয়ে।  ছবি: প্রথম আলো
অনলাইনে ক্যাসিনো ব্যবসার মূল হোতা সেলিম প্রধান। আটকের পর গুলশান-২–এ তাঁর কার্যালয়ে। ছবি: প্রথম আলো

অনলাইনে ক্যাসিনো ব্যবসা চালিয়ে মাসে কোটি কোটি টাকা আয় করতেন মুদ্রণ ব্যবসায়ী সেলিম প্রধান। আয়ের বড় একটি অংশ তিনি বিদেশে পাচার করতেন। সেলিমকে আটকের পর তাঁর গুলশানের অফিস, বাসায় এবং বনানীর অফিসে ২৪ ঘণ্টার অভিযান শেষে গতকাল মঙ্গলবার র‍্যাব এসব জানায়।

সোমবার ব্যাংককগামী একটি ফ্লাইট থেকে তাঁকে নামিয়ে আনা হয়। সেলিমের দুই সহযোগী আক্তারুজ্জামান ও রোকনকেও আটক করা হয়েছে। তাঁর সব ব্যাংক হিসাবের লেনদেন গতকাল থেকে স্থগিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

 র‍্যাব জানায়, অভিযানে সেলিমের কাছ থেকে ২৯ লাখ ৫ হাজার ৫০০ টাকা, ৭৭ লাখ ৬৩ হাজার টাকার সমপরিমাণ ২৩টি দেশের মুদ্রা, ১২টি পাসপোর্ট, ১৩টি ব্যাংকের ৩২টি চেক, ৪৮ বোতল বিদেশি মদ, একটি বড় সার্ভার, চারটি ল্যাপটপ ও দুটি হরিণের চামড়া উদ্ধার করা হয়েছে। হরিণের চামড়া উদ্ধারের ঘটনায় বন্য প্রাণী সংরক্ষণ নিরাপত্তা আইনে তাঁকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

সেলিমকে উড়োজাহাজ থেকে নামিয়ে আনার পর তাঁকে নিয়ে সোমবার রাত থেকে অভিযান শুরু করে র‍্যাব। অভিযান শেষে গতকাল গুলশানে সেলিমের বাসার নিচে সংবাদ বিফ্রিংয়ে র‍্যাব-১-এর অধিনায়ক সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, র‍্যাবের সাইবার মনিটরিং সেলে দেখা যায়, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অনলাইনে ক্যাসিনো গেমিং করছিলেন। এ অনলাইন গেমিংয়ের প্রধান সমন্বয়ক সেলিম প্রধান। তিনি দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন।

অনলাইনে ক্যাসিনো সম্পর্কে র‍্যাব কর্মকর্তা বলেন, প্রথমে একজন জুয়াড়িকে মোবাইল ফোনে টি-২১ ও পি-২৪ নামের দুটি অ্যাপস ডাউনলোড করতে হয়। অ্যাপসগুলো থেকে পছন্দমতো গেম বাছাই করে খেলতে হয়। তবে খেলার আগে অ্যাপের অ্যাকাউন্টে টাকা জমা রাখা লাগে। হারলে সেই টাকা কাটা যায়। জিতলে বাড়তি টাকা হিসাবে জমা হয়। টাকা জমা হয় সব ধরনের মোবাইল ব্যাংকিং ও কার্ডের মাধ্যমে। এভাবেই চলে অনলাইন ক্যাসিনো।

র‍্যাব জানায়, অ্যাপ অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া টাকা তিনটি ব্যাংকের হিসাবে স্থানান্তর করতেন সেলিম। আক্তারুজ্জামান নামে তাঁর এক সহকারী প্রতি সপ্তাহে সেই টাকা তুলে আরও দুটি ব্যাংকে জমা করতেন।

কত টাকা আয় করেছেন জানতে চাইলে লে. কর্নেল সারওয়ার বলেন, একটি মাত্র গেটওয়েতে কেবল এক মাসেই প্রায় ৯ কোটি টাকা জমা হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এই টাকা বিদেশে পাঠানো হতো। তিনি বলেন, কারাবন্দী গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের সঙ্গে সেলিমের একসময় ভালো সম্পর্ক ছিল। তাঁকে একটি বিএমডব্লিউ গাড়িও উপহার দিয়েছিলেন সেলিম।

>

একটি হিসাবে এক মাসে লেনদেন ৯ কোটি টাকা
সব ব্যাংক লেনদেন স্থগিত
বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনে ৬ মাসের কারাদণ্ড

ব্রিফিংয়ে বলা হয়, এ কার্যক্রমে সেলিমের একজন ব্যবসায়িক অংশীদার ছিলেন। উত্তর কোরিয়ার বাসিন্দা ওই ব্যক্তির নাম মি. দো। ক্যাসিনোর টাকা দোর সঙ্গে সমান ভাগ করে নিতেন। সেলিমের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় থাইল্যান্ডে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেলিম প্রধানের পৈতৃক বাড়ি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার ভুলতা মর্তুজাবাদ এলাকায়। তবে সেখানে কেউ থাকেন না। তাঁর বাবা মৃত নান্নু মিয়া একসময় ঢাকায় ব্যবসা করতেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে সেলিম মেজ। ১৯৯৩ সালের দিকে তিনি জাপান চলে যান। সেখানে গিয়ে গাড়ির ব্যবসা শুরু করেন। এরপর জাপান থেকে চলে যান থাইল্যান্ডে। সেখানে শিপ ব্রেকিংয়ের ব্যবসায় নামেন। দোর সঙ্গে পরিচয় হলে তিনি সেলিমকে অনলাইনে গেমিং সাইট খোলার পরামর্শ দেন।

র‍্যাব জানায়, সেলিমের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, বৈদেশিক মুদ্রা আইন ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ নিরাপত্তা আইন, ২০১২ অনুযায়ী চারটি মামলা হয়েছে।

সেলিমের ব্যাংক হিসাব স্থগিত

অনলাইন জুয়া ও ক্যাসিনো ব্যবসার হোতা সেলিমের সব ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে তাঁর নিজের ও প্রতিষ্ঠানের হিসাব থেকে আর কোনো টাকা উত্তোলন করা যাবে না। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) গতকাল সব ব্যাংকের কাছে পাঠানো চিঠিতে এ নির্দেশনা দিয়েছে।

চিঠিতে সেলিম প্রধানের তিনটি ঠিকানা দেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো গুলশান-২-এর ১১/এ সড়কের মমতাজ ভিশন, কারওয়ান বাজারের সোনারগাঁও রোডের প্ল্যানার্স টাওয়ার ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ভুলতার প্রধান বাড়ি। হান্নান প্রধান ও হাসিনা বেগমের সন্তান সেলিম প্রধান।

জাপান-বাংলাদেশ জেবি গ্রুপ নামে সেলিমের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। জেবি সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড পেপারস নামেও একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেলিম এসব প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। পি-২৪ নামের একটি ল ফার্মেরও মালিক তিনি।

 সেলিম প্রধানের জাপান-বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড পেপারসে বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই ছাপা হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সনদ ও অফিসের নথিপত্রও ছাপানো হয়। তাঁর এই প্রতিষ্ঠান রূপালী ব্যাংকের শীর্ষ ঋণখেলাপিদের একটি। ২০১৮ সালে ঋণটি পুনঃ তফসিল করা হয়। সেলিমের কাছে ব্যাংকের পাওনা প্রায় ১০০ কোটি টাকা।