রাজউক এখন আবাসন ব্যবসায়ীর ভূমিকায়

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

ঢাকার আবাসনসংকটের সমাধানে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) নয়টি বহুতল আবাসিক ভবনে ১৮১টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করলেও আগ্রহীদের এগুলো কিনতে হবে প্রায় বাজারদরে। একেকটির দাম পড়বে এক কোটি থেকে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত। এমন দামে ফ্ল্যাটগুলো বিক্রি করলে রাজউকের লাভ হবে প্রায় ২৯ শতাংশ। অথচ আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাঁদের লক্ষ্য থাকে একটি প্রকল্প থেকে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ লাভ করা।

এমন অবস্থায় রাজউকের উদ্দেশ্য ব্যবসা করা না আবাসন সমস্যার সমাধান—তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফ্ল্যাট বিক্রি করে লাভ করা রাজউকের কাজ নয়। এটি আবাসন ব্যবসায়ীদের কাজ। 

 রাজউক থেকে পাওয়া নথি ও ভবনের প্রসপেক্টাস বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সরকারি সংস্থা হয়ে রাজউক আবাসন ব্যবসায়ীদের মতো বাজারদরে ফ্ল্যাট বিক্রি করছে। প্রায় ৩৩৯ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সংস্থাটির লাভ হবে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে জানতে যোগাযোগ করা হয় গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের সঙ্গে। প্রকল্পটি তাঁর মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগের হওয়ায় এ সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত জানেন না উল্লেখ করে মন্তব্য করতে চাননি।

তবে রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন) শামসুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আবাসন সংকট মেটানো এবং যাঁরা বাজারদরে ফ্ল্যাট কিনতে পারেন না, তাঁদের জন্যই প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে। প্রকল্প থেকে প্রায় ১০০ কোটি টাকা লাভ করার তথ্য সঠিক নয় বলে তিনি দাবি করেন। তাঁর দাবি, এই প্রকল্পে ২০ কোটি টাকার মতো লাভ ধরা হয়েছে। 

রাজউকের এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে গুলশান, ধানমন্ডি, লালমাটিয়া ও মোহাম্মদপুর এলাকায়। যে জায়গায় ভবনগুলো নির্মাণ করা হবে, তা পরিত্যক্ত সম্পত্তি বা বাড়ি হিসেবে স্বীকৃত। অর্থাৎ ভবন নির্মাণের জন্য নির্ধারিত জমিগুলো কেউ না কেউ বরাদ্দ পেয়েছিলেন বা কিনেছিলেন। এখন এর সঠিক মালিকানা নেই। পরে এই জায়গাগুলো জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে অধিগ্রহণ করে ভবন নির্মাণ (অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প) নিয়েছে রাজউক।

ইতিমধ্যেই গুলশানের ৩১ নম্বর রোড, লালমাটিয়ার ই ব্লক ও মোহাম্মদপুরের খিলজি রোডের তিনটি ভবনের ফ্ল্যাট বিক্রির জন্য বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে সংস্থাটি। রাজউক আবেদন যাচাই-বাছাই করে লটারির মাধ্যমে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেবে। বাকি ছয়টি ভবন নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন।

বাজারদরে ফ্ল্যাট বিক্রি
ঢাকায় পরিত্যক্ত নয়টি ভবনে ১৮১টি ফ্ল্যাট বানাবে রাজউক
আবাসন পরিদপ্তরকে ৩৬টি ফ্ল্যাট দিয়েও প্রায় ১০০ কোটি টাকা লাভ করবে সংস্থাটি

প্রকল্পের আওতায় গুলশানের ৩৫ নম্বর সড়কে ৪ হাজার এবং ৪ হাজার ৩৯৫ বর্গফুট আয়তনের ৩৬টি, ৩১ নম্বর সড়কে ২ হাজার ৩২০ ও ২ হাজার ৪০৬ বর্গফুট আয়তনের ১৬টি; ধানমন্ডির ২১ নম্বর সড়কের একটি ভবনে ২ হাজার ৫২২, ২ হাজার ৬৩০ ও ২ হাজার ৬০৮ বর্গফুট আয়তনের ৩৩টি; লালমাটিয়ার ই ব্লকের একটি প্লটে ২ হাজার ৩৫৯ বর্গফুট আয়তনের ৮টি; মোহাম্মদপুরে স্যার সৈয়দ রোডের একটি ভবনে ১ হাজার ৮০০ বর্গফুটের ১০টি, বাবর রোডের একটি ভবনে ১ হাজার ৬২০ বর্গফুটের ১২টি, খিলজি রোডের একটি ভবনে ১ হাজার ৪৫৮ বর্গফুটের ৩০টি ও আওরঙ্গজেব রোডের দুটি ভবনে ১ হাজার ৩৩০ ও ১ হাজার ৬৫৫ বর্গফুট আয়তনের ৩৬টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হবে। 

নির্মাণ করা মোট ১৮১টি ফ্ল্যাটের মধ্যে মোহাম্মদপুরের আওরঙ্গজেব রোডের ৩৬টি ফ্ল্যাট সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসন সুবিধার জন্য জাতীয় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আবাসন পরিদপ্তরকে বিনা মূল্যে দেওয়া হবে। বাকি ১৪৫টি ফ্ল্যাট বিক্রি করে প্রকল্পের ব্যয় মিটিয়ে লাভ করবে রাজউক।

 গুলশানে প্রতি বর্গফুটের দাম ধরা হয়েছে ১৩ হাজার ৫০০ টাকা, ধানমন্ডিতে ১২ হাজার টাকা ও লালমাটিয়ায় ১০ হাজার টাকা। মোহাম্মদপুরে সৈয়দ রোডের ফ্ল্যাটের প্রতি বর্গফুটের দাম হবে ৯ হাজার টাকা, বাবর ও খিলজি রোডে ৭ হাজার টাকা।

আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেন, প্রায় বাজারদর ধরেছে রাজউক। মোহাম্মদপুরে বরং একটু বেশি দাম ধরেছে। তিনি জানান, সাধারণত কোনো প্রকল্প থেকে তাঁরা মোট বিনিয়োগের ১০-২০ শতাংশ লাভ করেন। তবে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ লাভ ধরা থাকে।

রাজউকের হিসাব অনুযায়ী, গুলশানের একটি ফ্ল্যাটের দাম পড়বে ৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা, ধানমন্ডিতে প্রায় ৩ কোটি ২ লাখ টাকা ও লালমাটিয়ায় প্রায় ২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এর বাইরে পার্কিং ও ইউটিলিটি সেবার জন্য এলাকাভেদে টাকা দিতে হবে। এই হিসাবে প্রকল্প থেকে রাজউকের মোট আয় হবে (পার্কিং, ইউটিলিটিসহ) ৪৩৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এতে লাভ হবে অন্তত ৯৯ কোটি টাকা।

প্রকল্পটি সম্পর্কে নগর বিশেষজ্ঞ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘রাজউক অবশ্যই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নয়। এর মূল কাজ পরিকল্পনা প্রণয়ন, নির্মাণ অনুমোদন ও উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু তা না করে দীর্ঘদিন থেকেই সংস্থাটি ধনীর তোষণ নীতিতে চলছে। তাই এ ধরনের প্রকল্পের আমরা সম্পূর্ণ বিরোধী।’ তিনি মনে করেন, তারপরও এমন প্রকল্প নিতে হলে ফ্ল্যাটের দাম বাজারদরের চেয়ে অনেক কম হতে হবে। যাতে বাজারদরে যাঁরা ফ্ল্যাট কিনতে পারছেন না, তাঁরা কিনতে পারেন।