'লাগেজ পার্টি' থেকে যুবলীগ, ক্যাসিনো ও সিনেমায়

এনামুল হক আরমান
এনামুল হক আরমান

পড়ালেখায় বেশি দূর এগোতে পারেননি তিনি। শৈশবেই ফেনীর ছাগলনাইয়া থেকে চলে আসেন ঢাকায়। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে বিদেশ থেকে ‘লাগেজ পার্টির’ আনা ইলেকট্রনিক পণ্য বায়তুল মোকাররম এলাকার দোকানে দোকানে বিক্রি করতেন। পরে নিজেই লাগেজ পার্টির কারবারে যুক্ত হন। ২০১৩ সালে যুবলীগের পদ পেয়ে অল্প সময়ে গড়ে তুলেছেন বিত্তবৈভব। জুয়া-ক্যাসিনোর টাকায় নেমেছেন সিনেমা প্রযোজনায়ও।

তিনি হলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সহসভাপতি এনামুল হক ওরফে আরমান। তিনি ঢাকার অপরাধজগতের অন্যতম নিয়ন্ত্রক ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের অন্যতম সহযোগী।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর মতিঝিলের ক্লাবপাড়ার ক্যাসিনোতে অভিযান শুরু হলেই আলোচনায় চলে আসেন আরমান। অভিযান টের পেয়ে পালিয়ে যান ঢাকার বাইরে। গতকাল রোববার ভোরে সম্রাটের সঙ্গে আরমানকেও গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। অবশ্য গ্রেপ্তারের পর গতকাল বিকেলে যুবলীগ থেকে আরমানকে বহিষ্কার করেছে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি।

যুবলীগের একাধিক সূত্র জানায়, আরমানের উত্থানের পেছনে ভূমিকা রেখেছেন যুবলীগ মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট। একই জেলায় বাড়ি বলেই সম্রাটের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল আরমানের। সেই সুবাদেই ২০১৩ সালে যুবলীগের মহানগর দক্ষিণের সহসভাপতির পদ পান। সম্রাটের ছত্রচ্ছায়ায় ক্লাবপাড়ার ক্যাসিনো ও জুয়া-বাণিজ্যের অন্যতম নিয়ন্ত্রকে পরিণত হন আরমান।

দুজনের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, বিএনপি সরকারের (২০০১-০৬) সময়ে মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় জুয়ার ব্যবসায় ঢুকে যান আরমান। এ ছাড়া লাগেজ পার্টির কারবার করায় সিঙ্গাপুরে ক্যাসিনোতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল আরমানের। তিনিই সম্রাটকে ক্যাসিনো ব্যবসায় আগ্রহী করেন বলে প্রচার আছে। সম্রাটের হয়ে পুরো ক্যাসিনো ব্যবসা দেখভালের দায়িত্ব পালন করতেন আরমান।

>

ফেনীর ছাগলনাইয়া থেকে ঢাকায় এসে যুক্ত হন ‘লাগেজ পার্টিতে’
২০১৩ সালে যুবলীগের পদ পেয়েই গড়ে তুলেছেন বিত্তবৈভব

জানা গেছে, সম্রাট ও তাঁর বিশেষ মেহমানদের জন্য প্রায়ই নাচ-গানের ‘বিশেষ পার্টির’ ব্যবস্থা করতেন আরমান। এ কারণে রুপালি পর্দার তারকাদের প্রতি আগ্রহ ছিল তাঁদের। সম্রাটের পক্ষ হয়েই সিনেমা প্রযোজনায় নামেন আরমান। তাঁর প্রযোজনা সংস্থার নাম ‘দেশ বাংলা মাল্টিমিডিয়া’। গত ১২ আগস্ট ঈদুল আজহা উপলক্ষে এই প্রযোজনা সংস্থা থেকে মুক্তি পায় মনের মতো মানুষ পাইলাম না। সাড়ে তিন কোটি টাকা ব্যয়ে এই ছবি নির্মিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রযোজনা সংস্থার একজন কর্মকর্তা। বর্তমানে কক্সবাজারে এই প্রযোজনা সংস্থার দ্বিতীয় ছবি আগুন–এর শুটিং চলছে। এই ছবি নির্মাণে কয়েক কোটি টাকা ব্যয় হবে বলে মনে করছেন চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

 গত ১৮ জুন ঢাকা ক্লাবে মনের মতো মানুষ পাইলাম না ছবির মহরত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী মো. মুরাদ হাসান, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নূরুন্নবী চৌধুরী শাওন, তথ্যসচিব আবদুল মালেক। এরপর ৩০ জুলাই আগুন ছবির মহরত হয় হোটেল সোনারগাঁওয়ে। ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বিশেষ অতিথি ছিলেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী মো. মুরাদ হাসান।

বাংলা সিনেমার এক পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সম্রাট আগেও বিভিন্ন সময় সিনেমায় বিনিয়োগ করেছেন। তবে কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে তা প্রকাশ করা হয়নি। আরমান মূলত সম্রাটের হয়েই সিনেমার প্রযোজনায় নামেন।

আরমানের বাড়ি ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার পাঠাননগর ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামে। তাঁর বাবা মুন্সি রফিকুল ইসলাম ছিলেন পাঠাননগর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য। তাঁর মা একজন গৃহিণী। তাঁরা ছয় ভাই। আরমান দ্বিতীয়। এক ভাই গ্রামের বাড়িতেই থাকেন। অন্য পাঁচ ভাই ঢাকায় বসবাস করেন। স্থানীয় ইউপি সদস্য মুসা মিয়া প্রথম আলোকে জানান, আরমান খুব কমই বাড়িতে আসেন। একটি একতলা দালানঘর ছাড়া পৈতৃক বাড়িতে কিছু নেই তাঁদের। দুই বছর আগে স্থানীয় কাচারিবাজার অগ্রণী উচ্চবিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি হন আরমান।

এ ধরনের ব্যক্তিরা কীভাবে যুবলীগে পদ পান—জানতে চাইলে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তো সতর্ক ছিলাম না। এর মধ্যে কেউ কেউ দলে ঢুকে পড়েছে। পদ দেওয়ার ক্ষেত্রেও কিছু ভুল হতে পারে। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এখন এগোতে চা​ই।’