চাঁদা না পেলে বৈদ্যুতিক শক দিত সম্রাট বাহিনী

ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট। ছবি: সম্রাটের ফেসবুক পেজ থেকে
ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট। ছবি: সম্রাটের ফেসবুক পেজ থেকে

চাঁদাবাজির জন্য একটি বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট। কেউ চাঁদা দিতে না চাইলে প্রথমে তাঁকে লাঠিপেটা করা হতো। এতেও কাজ না হলে দেওয়া হতো বৈদ্যুতিক শক। এ জন্য বৈদ্যুতিক সরঞ্জামও ছিল তাঁদের। এর বাইরেও ১০টি ক্যাসিনো ছিল সম্রাটের। সম্রাটের বিরুদ্ধে রমনা থানায় দায়ের করা অস্ত্র আইনের মামলায় এসব অভিযোগ করেছে র‍্যাব।

কাকরাইলে সম্রাটের কার্যালয়টি রমনা থানা থেকে ২০০ গজের ভেতরে। এত দিন এসব অপরাধ হলেও পুলিশ কেন ব্যবস্থা নেয়নি? রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী মাইনুল ইসলামের কাছে এ প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা আগে এসব জানতাম না।’

তবে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, সম্রাটের এসব অপকর্মে পুলিশ সব সময় বিশেষ সুবিধা দিয়ে এসেছে। ক্ষমতাসীন দলের পদে থাকায় সম্রাট ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশ তাঁকে ও তাঁর অনুগত বাহিনীকে সহায়তা দিয়ে এসেছে। বিশেষ করে ক্যাসিনো থেকে অনেক পুলিশ সদস্য নিয়মিত টাকা পেতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মহানগর পুলিশের একটি দল এ অভিযোগ খতিয়ে দেখছে।

এদিকে সম্রাট গ্রেপ্তারের পর তাঁর সহযোগীরা গা ঢাকা দিয়েছেন। গতকাল ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টারে কাউকে দেখা যায়নি। সম্রাটের জমজমাট কার্যালয় খাঁ খাঁ করছিল। অভিযানের পর গত রোববার র‍্যাব ভবনটি সিলগালা করে দিয়েছে। সম্রাটকে কারাগারে নেওয়ার সময় যুবলীগের কর্মীরা তাঁর পক্ষে স্লোগান দেন। এ ঘটনায় গতকাল তিনজনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়।

সম্রাট ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী এনামুল হক আরমানের বিরুদ্ধে গতকাল তিনটি মামলা করেছে র‍্যাব। এর মধ্যে ঢাকার রমনা থানায় তাঁদের বিরুদ্ধে দুই আইনে দুটি মামলা হয়েছে। আর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানায় আরমানের বিরুদ্ধে মাদক আইনের একটি মামলা হয়েছে।

রমনা থানায় দুটি মামলার মধ্যে একটি অস্ত্র আইনে, অন্যটি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে। অস্ত্র আইনের মামলায় শুধু সম্রাটকে আসামি করা হয়েছে। আর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় সম্রাটের সঙ্গে আরমানকেও আসামি করা হয়েছে।

গত রোববার ভোররাতে যুবলীগের নেতা সম্রাট ও তাঁর সহযোগী এনামুল হককে কুমিল্লার মুরাদনগর থেকে আটক করে ঢাকায় কুর্মিটোলায় র‍্যাব সদর দপ্তরে আনা হয়। সেখানে মদ্যপ অবস্থায় পাওয়ায় আরমানকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়ে কুমিল্লার কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। সম্রাটের তথ্যের ভিত্তিতে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে র‍্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত রোববার দুপুরে কাকরাইলে ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টারে অভিযান চালান। সেখান থেকে পিস্তল, গুলি, ইয়াবা বড়ি বিদেশি মদ উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া দুটি ক্যাঙারুর চামড়া, বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার দুটি যন্ত্র, ও লাঠি উদ্ধার করা হয়। বন্য প্রাণীর চামড়া রাখার দায়ে সম্রাটকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। এ ছাড়া অস্ত্র মামলায় সম্রাটকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেছে পুলিশ।

র‍্যাব-১–এর নায়েক সুবেদার মো. আবদুল খালেকের করা মামলায় বলা হয়, সম্রাট ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি হিসেবে দলের ছত্রচ্ছায়ায় প্রভাব বিস্তার করে বিভিন্ন ক্লাবে ক্যাসিনো চালাতেন। তাঁর নিয়ন্ত্রণে থাকা ১০টি ক্লাবে ক্যাসিনোসহ জুয়ার আসর বসত। জুয়া থেকে তিনি বিপুল অর্থসম্পত্তির মালিক হন। তিনি নিজেও ক্যাসিনোতে খেলেন। ক্যাসিনোতে খেলার জন্য প্রতি মাসে তিনি সিঙ্গাপুরে যেতেন। সবার কাছে তিনি ক্যাসিনো সম্রাট হিসেবে পরিচিত। ক্যাসিনো ব্যবসার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি করতেন। তাঁর রয়েছে বিশাল ক্যাডার বাহিনী। অবৈধ উপার্জন দিয়ে তিনি এই ক্যাডার বাহিনী পুষতেন। তাঁর বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে এবং চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে ক্যাডার বাহিনী তাঁকে আটকে রেখে বৈদ্যুতিক শক দিত এবং লাঠিপেটা করত। সম্রাটের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়

মামলার বিবরণে আরও উল্লেখ করা হয়, সম্রাটের অন্যতম সহযোগী মহানগর দক্ষিণের যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর এ কে এম মমিনুল হক ওরফে সাঈদ, মহানগর যুবলীগের দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক পদ থেকে বহিষ্কৃত ও ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস ক্লাবের সভাপতি খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। এর মধ্যে র‍্যাব খালেদ মাহমুদ কয়েক দিন আগে (১৮ সেপ্টেম্বর) অবৈধ অস্ত্র, ক্যাসিনো সরঞ্জামসহ গ্রেপ্তার হন। রিমান্ডে নিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে র‍্যাব।

রমনা থানায় করা মাদকদ্রব্য আইনের মামলায় বলা হয়, গত রোববার র‍্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানার কুঞ্জ শ্রীপুরে সম্রাট ও তাঁর সহযোগী আরমানকে আটক করেন। সম্রাটের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে কাকরাইলের ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টারে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ মদ ও ইয়াবা বড়ি ও মাদক উদ্ধার করা হয়। সম্রাট স্বীকার করেন, আরমানের সহযোগিতায় তিনি মাদকদ্রব্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেছেন। তাই সম্রাট ও তাঁর সহযোগী আরমানের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করে র‍্যাব।

আরমান
আরমান


কুমিল্লায় আরমানের বিরুদ্ধে মামলা
নিজস্ব প্রতিবেদক, কুমিল্লা জানান, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার আলকরা ইউনিয়নের কুঞ্জ শ্রীপুর গ্রাম থেকে আটক হওয়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সহসভাপতি বহিষ্কৃত এনামুল হক ওরফে আরমানকে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের কপোতাক্ষ সেলের ৩ নম্বর কক্ষে রাখা হয়েছে। গত রোববার রাত ১০টা ৫০ মিনিটে তাঁকে র‍্যাব-৭–এর একটি গাড়িতে করে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়। কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ জেল সুপার জাহানারা বেগম প্রথম আলোকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

উল্লেখ, র‍্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের কুঞ্জ শ্রীপুর গ্রাম থেকে এনামুল হক আরমানকে মদ্যপ অবস্থায় পান। একই সঙ্গে তাঁর কাছে বিদেশি মদ থাকার কারণে তাঁকে ভ্রাম্যমাণ আদালত ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন। সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে তাঁকে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়েছে।

এদিকে এনামুল হক ওরফে আরমানের বিরুদ্ধে গত রোববার রাতে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানায় মাদক আইনে একটি মামলা হয়েছে। র‍্যাব-৭–এর নিরস্ত্র উপপরিদর্শক (এসআই) সজীব মিয়া বাদী হয়ে চৌদ্দগ্রাম থানায় ১৪০টি ইয়াবা বড়ি সঙ্গে রাখায় ওই মামলা দায়ের করেন। এই মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ।

র‍্যাব সূত্রে জানা গেছে, ইসমাইল হোসেন সম্রাট ও এনামুল হক আরমানের বাড়ি ফেনী জেলায় হওয়ার কারণে তাঁদের মধ্যে সখ্য ছিল বেশি। দুজনই চেয়েছিলেন ফেনী অথবা চৌদ্দগ্রাম সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে। কিন্তু তার আগেই র‍্যাবের হাতে আটক হন এই দুই প্রভাবশালী নেতা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের সঙ্গে গ্রেপ্তারের আগে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম ও ফেনীর কার কার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ ছিল, তা খতিয়ে দেখছেন।

কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের ডেপুটি জেলার বিলাল হোসেন বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতের সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে এনামুল হক আরমানকে গত রোববার রাত ১০টা ৫০ মিনিটে কারাগারে আনে র‍্যাব। তিনি বর্তমানে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন।