পরিচিতদের হাতেই শিশু ধর্ষণ বেশি

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

পরিচিতদের দ্বারাই মূলত শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে তুলনামূলক কম বয়সী শিশুরা প্রতিবেশীর হাতে ধর্ষণের শিকার হয়। আর কিশোরীরা প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়।

দেশের সরকারি ১১টি ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) সেবা নেওয়া ধর্ষণের শিকার শিশুদের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এই চিত্র পাওয়া গেছে। ওসিসি হচ্ছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত মাল্টিসেক্টরাল কর্মসূচির একটি অন্যতম কার্যক্রম।

মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, রাষ্ট্রের দায়িত্ব শিশুদের সুরক্ষা দেওয়া, কিন্তু তাতে তারা ব্যর্থ। ধর্ষকদের বিচার না হওয়ায় অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের উচিত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি শিশু ধর্ষণ প্রতিরোধে সহযোগী হওয়া।

২০০০ সালে এই কর্মসূচি শুরুর পরে প্রথমে ঢাকা ও রাজশাহীতে ওসিসি চালু করা হয়। এরপর ক্রমান্বয়ে চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, খুলনা, রংপুর, ফরিদপুর, কক্সবাজার, বগুড়া, কুমিল্লাতে চালু করা হয়। ওসিসি থেকে সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা, পুলিশি সহায়তা, ডিএনএ পরীক্ষা, আইনি সহায়তা ও পরামর্শসেবা দেওয়া হয়।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ওসিসিতে ৯৬৯ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়ে সেবা নিয়েছে। এর মধ্যে প্রতিবেশীদের হাতে ও প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে ৬২ শতাংশ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

মাল্টিসেক্টরাল কর্মসূচির পরিচালক আবুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এ কর্মসূচি থেকে মূলত শিশুদের ধর্ষণ–পরবর্তী সেবা দেওয়া হয়। তবে উঠান বৈঠক ও বেশ কয়েকটি কর্মসূচিতে এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করা হয়।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথম আট মাসে ৬৯৭ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ১০টি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে হিসাব রাখে সংগঠনটি। বিএসএএফ শিশু অধিকার বিষয়ে কাজ করে, এমন ২৬৯টি বেসরকারি সংগঠন বা এনজিওর জাতীয় নেটওয়ার্ক। ২০১৮, ২০১৭ ও ২০১৬ সালে এ সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৫৭১, ৫৯৩, ৪৪৬।

ওসিসির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতিবেশীদের হাতে একটি বড় অংশ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, এ হার ৩২ শতাংশ। প্রতিবেশীদের হাতে ধর্ষণের শিকার শিশুদের বয়স তুলনামূলক কম। সর্বনিম্ন দুই বছরের শিশু প্রতিবেশীর কাছে ধর্ষণের শিকার হয়ে ওসিসিতে এসেছে। এসব ঘটনার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ খেলতে গিয়ে ঘটেছে। আবার শিশুর নিজের বসতঘরেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণের অভিযোগ আছে কিশোর প্রতিবেশী থেকে শুরু করে ষাটোর্ধ্ব পুরুষের বিরুদ্ধে।

নোয়াখালী সদর উপজেলায় গত ২২ জুলাই সাত বছরের এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। শিশুটির চাচা প্রথম আলোকে বলেন, বিকেল পাঁচটার দিকে শিশুটি নিজ বাড়ির উঠানে খেলছিল। এ সময় ২১ বছরের এক প্রতিবেশী তরুণ শিশুটিকে ঘরে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করেন। চিৎকার শুনে শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের নারী সহায়তা ও তদন্ত বিভাগে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন উপকমিশনার ফরিদা পারভীন। শিশু ধর্ষণের ক্ষেত্রে তিনিও একই রকম প্রবণতা দেখেছেন বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, কম বয়সী শিশুরা পরিচিতজন বা স্বজনের মাধ্যমেই ধর্ষণের শিকার হয়। শিশু ধর্ষণের ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধর্ষকের বয়স ৪০–এর বেশি।

ওসিসির তথ্য আরও বলছে, প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২৯ শতাংশের বেশি। এ ঘটনার সংখ্যা ২৮৫টি। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কিশোরীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এ ধরনের ঘটনার শিকার হয়।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক আহমেদ হেলাল প্রথম আলোকে বলেন, কম বয়সী শিশুরা তুলনামূলক দুর্বল এবং প্রতিবেশী-পরিচিতজনদের হাতের নাগালে থাকে। তাই তারাই হয় সহজ শিকার। আর কিশোরীরা কাছের গণ্ডি ভেঙে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে গেলে আবেগের ফাঁদে ফেলে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।

প্রতিরোধে নজর কম

সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে শিশু ধর্ষণ নিয়ে নানা ধরনের কাজ চললেও প্রতিরোধের বিষয়ে নজর কম। অবশ্য কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সীমিতভাবে এ বিষয়ে ধারণা দেওয়া শুরু করেছে। তবে অভিভাবকেরা এ বিষয়ে তেমন সচেতন নয়। এমনকি প্রতিদিন শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেও নিজের সন্তানের সঙ্গে এমনটা হবে না বলে মনে করেন অভিভাবকেরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ধানমন্ডির এক নারী বলেন, ‘ধর্ষণের মতো ঘটনা আমার পরিবারে ঘটার সম্ভাবনা নেই। আর ৯ বছরের মেয়ের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলাও বিব্রতকর।’ তখন সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া কয়েকটি ধর্ষণের উদাহরণ টানলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে তিনি মেয়ের সঙ্গে কথা বলবেন।

যেহেতু পরিচিতজনদের কাছেই বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, সেহেতু এ ক্ষেত্রে সচেতনতার একটি বড় ভূমিকা আছে উল্লেখ করে মনোরোগ চিকিৎসক আহমেদ হেলাল বলেন, অভিভাবককে সচেতন হয়ে সন্তানকে ভালো স্পর্শ ও খারাপ স্পর্শের পার্থক্য বোঝাতে হবে। আত্মীয় বা পরিচিতজনের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। এ রকম পরিস্থিতিতে কী করণীয়, সে সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। শিশুদের কথা শুনতে হবে। প্রতিরোধের পাশাপাশি ধর্ষকের নৈতিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনেও কাজ করতে হবে।