নির্যাতনের অভিযোগ করছিলেন বুয়েট ছাত্ররা, পেজটি বন্ধ করল বিটিআরসি

শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ জানাতে বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের শিক্ষার্থীদের চালু করা ওয়েবপেজটি বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। সংস্থার চেয়ারম্যান মো. জহুরুল হক ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) হলগুলোতে ভিন্নমতের কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের ঘটনা বহুদিনের। বুয়েটের সিএসই বিভাগের তৈরি করা ওয়েবপেজে গত আড়াই বছরে শিক্ষার্থীরা ১০৩টি অভিযোগ করেছেন। শিক্ষার্থীদের এসব অভিযোগের বিষয়ে প্রশাসনকে জানানো হলেও তা বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

২০১৬ সালের শেষ দিকে বুয়েটের সিএসই বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী মিলে ওয়ানস্টপ অনলাইন রিপোর্টিং সিস্টেম (ইউ রিপোর্টার) নামে একটি সার্ভার গড়ে তোলেন। এতে বুয়েটের যেকোনো শিক্ষার্থী নিজের পরিচয় প্রকাশ না করে অভিযোগ জানাতে পারেন। গতকাল বুধবার পর্যন্ত ১০৩টি অভিযোগ সার্ভারে জমা হয়েছে। এর মধ্যে গত রোববার রাতে বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার পর বেশ কিছু নতুন অভিযোগ জমা পড়েছে।

বিটিআরসি গতকাল বুধবার এক চিঠিতে ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ) এবং ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারীদের (আইএসপি) এই ওয়েবপেজটি বন্ধের নির্দেশ দেয়। বিষয়টি জানাজানি হয় রাতের দিকে।

এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার আজ বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, অন্যায় করে থাকলে পেজ বন্ধ করে দেওয়া হবে। তবে বন্ধ করা হয়েছে কি না, তা তিনি জানেন না।

আজ বৃহস্পতিবার সকালে বিটিআরসির চেয়ারম্যান মো. জহুরুল হক বলেন, নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করতে পারে, এই আশঙ্কা থেকে পেজটি বন্ধ করা হয়েছে।

ওয়েবপেজটি দেখভাল করছিলেন সিএসই বিভাগের অধ্যাপক মোস্তফা আকবর। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কাজ অভিযোগগুলো জমা দেওয়া। জমা পড়া অভিযোগগুলো দুই মাস আগে প্রিন্ট করে ছাত্রকল্যাণ পরিচালককে দেওয়া হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় বা হল প্রশাসন দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।’

এসব অভিযোগের বিষয়ে গতকাল উপাচার্য সাইফুল ইসলামের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ছাত্রকল্যাণ পরিচালক মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তিন মাস আগে তিনি এ দায়িত্ব পান। তাঁর সময় তিনটি র‍্যাগিংয়ের অভিযোগ উঠলে হল পর্যায়ে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হয়েছে। অধিকতর তদন্তের জন্য বিষয়গুলো উপাচার্যের কাছে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এখনো কমিটি হয়নি।

পেজে জমা হওয়া অভিযোগগুলো ঘেঁটে দেখা যায়, র‍্যাগিং, ছাত্রলীগের মারধর, আবাসন ও ক্যানটিন সমস্যা, শিক্ষকদের ক্লাসের উপস্থিতি ইত্যাদি বিষয়ে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা। আবরার হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত ও বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদি হাসান ওরফে রাসেলের বিরুদ্ধেও শিক্ষার্থীদের নানাভাবে নিপীড়ন করার অভিযোগ রয়েছে।

অভিযোগের সূত্র ধরে গতকাল বুয়েটের বিভিন্ন আবাসিক হলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে প্রথম আলো। শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বা হলের কোনো বিষয়ে সমালোচনা করলে শিবির-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তোলা হয়। ছাত্রলীগের নির্যাতনের ভয়ে তাঁরা স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ করতে ভয় পান। র‍্যাগিংয়ের নামে শিক্ষার্থীদের মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনও করা হয়।

পেজে জমা হওয়া অভিযোগ থেকে জানা যায়, আবরার হত্যায় জড়িত ব্যক্তিরা সাধারণ ছাত্রদের নানাভাবে নির্যাতন করতেন। একটি অভিযোগ করা হয়েছে আবরার হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া বুয়েট ছাত্রলীগের সহসম্পাদক আশিকুল ইসলাম ওরফে বিটু, উপদপ্তর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ, উপসমাজকল্যাণ সম্পাদক ইফতি মোশারেফ ওরফে সকালের বিরুদ্ধে। তাতে বলা হয়েছে, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের একজন শিক্ষার্থীকে মারধর করে হল থেকে বের করে দেন এবং ওই শিক্ষার্থীর এক লাখ টাকা দামের একটি ল্যাপটপ রেখে দেন।

শেরে বাংলা হলের আবাসিক শিক্ষার্থী অমিত সাহার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের মারধরের একাধিক অভিযোগ রয়েছে। যে কক্ষে আবরারকে নির্যাতন করে মারা হয়, অমিত সাহা ওই কক্ষেরই একজন বাসিন্দা। তিনি বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক।

একটি অভিযোগে দেখা যায়, গত বছরের ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সমাবেশে ১৭ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ডাকা হয়। যাঁরা সমাবেশে যাননি, তাঁদের রাতে শেরে বাংলা হলের ছাদে ডেকে পাঠানো হয়। সমাবেশে না যাওয়ার অভিযোগে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে বেদম মারধর করা হয়। অমিত সাহার মারধরে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক বিভাগের এক শিক্ষার্থী আহত হন।

বুয়েটের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, প্রতিটি হলেই দু-তিনটি কক্ষ আছে, যেগুলো ‘রাজনৈতিক কক্ষ’ হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন ইস্যুতে, কারণে-অকারণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এসব কক্ষে ডেকে মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। হলের ‘রাজনৈতিক কক্ষ’ হিসেবে পরিচিত কক্ষগুলো সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য আতঙ্কের।

পেজে জমা হওয়া অভিযোগে দেখা যায়, ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে এম এ রশিদ হলের ৪০৫ নম্বর কক্ষে একজন ছাত্রকে মারধর করেন ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা। মারধরের কারণে ওই ছাত্রের পায়ের রগ ছিঁড়ে যায়। ওই ঘটনার অভিযুক্ত ব্যক্তিরা সবাই বুয়েট ছাত্রলীগের কমিটিতে পদধারী।

অভিযোগের বিষয়ে বুয়েট ছাত্রলীগের সহসভাপতি নাভিদুল হাসান ওরফে সৌরভ প্রথম আলোকে বলেন, বেয়াদবি করায় চড়-থাপ্পড় মারা হয়েছিল। স্টাম্প বা হকিস্টিক দিয়ে মারার অভিযোগ বানোয়াট।

২০১৮ সালের আগস্টে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময়েও বুয়েটের বিভিন্ন হলে শিক্ষার্থীদের মারধরের ঘটনা ঘটেছিল। একাধিক শিক্ষার্থী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ফেসবুকে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পক্ষে যাঁরা লেখালেখি করেছিলেন, তাঁদের বেশ কয়েকজনকে মারধর করা হয়।

ছাত্রলীগের বুয়েট শাখার সভাপতি খন্দকার জামী উস সানীর বিরুদ্ধেও হলের কক্ষে মারধরের অভিযোগ জমা পড়েছে। এ বিষয়ে জামী উস সানী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগটি বেশ পুরোনো। শিবির-সংশ্লিষ্টতা পাওয়ায় প্রশাসনের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। অভিযোগ থাকলে প্রশাসন তদন্ত করুক।

জামী উস সানী আহসান উল্লাহ হলের তিনজনের কক্ষে বর্তমানে একা থাকেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার নামে বরাদ্দ, আমি থাকি। এটি নিয়ে কিছু বলার নাই।’

ছাত্রলীগের বুয়েট শাখার সাবেক সভাপতি শুভ্র জ্যোতি টিকাদারের বিরুদ্ধেও শিক্ষার্থীদের মারধরের কয়েকটি অভিযোগ রয়েছে। গত জুনে একটি বাসা থেকে শুভ্র জ্যোতির ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

গত ৯ মে একজন অভিযোগে লিখেছিলেন, সিসি ক্যামেরা সচল থাকলে হলগুলোতে মধ্যরাতে র‍্যাগিংয়ের আলামত পাওয়া যাবে।

এ ব্যাপারে বুয়েটের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের অন্যায় বুয়েটে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। আগের অন্যায়গুলোর বিচার হয়নি বলেই এমন ঘটনা ঘটল। ভবিষ্যতে যাতে এমন নির্যাতনের ঘটনা না ঘটে, এ জন্য শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।