তিন লাশের পাশে চিরকুট, 'উই আর ভেরি সরি'

মিরপুরের এই বাড়ির একটি ফ্ল্যাট থেকে একই পরিবারের তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ঢাকা, ১০ অক্টোবর। ছবি: তানভীর আহাম্মেদ
মিরপুরের এই বাড়ির একটি ফ্ল্যাট থেকে একই পরিবারের তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ঢাকা, ১০ অক্টোবর। ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

রাজধানীর মিরপুর ১৩ নম্বর সেকশন। এই এলাকার একটি বাড়ির এক ফ্ল্যাটে পড়ে ছিল তিনটি লাশ। মা ও ছেলের লাশ ছিল বিছানার ওপর। বাবার লাশ ঝুলছিল ফ্যানের সঙ্গে। আর সারা ঘরে ছড়ানো ছিল অসংখ্য চিরকুট।

পুলিশ বলছে, চিরকুটগুলোতে লেখা, ‘উই আর ভেরি সরি। এই ঘটনার জন্য অন্য কেউ দায়ী নয়।’ ‘উই আর ভেরি সরি। আমাদের এমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না।’

উদ্ধার হওয়া তিন লাশের একটি এস এম বায়েজিদের (৪৫)। বাকি দুটি তাঁর স্ত্রী কোহিনুর পারভিনের (৩৮) ও উচ্চমাধ্যমিকপড়ুয়া ছেলে মো. ফারহানের (১৭)। ফ্ল্যাট থেকে বায়েজিদসহ অন্যদের লাশ আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে উদ্ধার করে পুলিশ।

প্রাথমিকভাবে পুলিশের ধারণা, তৈরি পোশাক ব্যবসায় ক্রমাগত লোকসানের কারণে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন বায়েজিদ। এ কারণে তিনি দীর্ঘদিন ধরে হতাশা ও বিষণ্নতায় ভুগছিলেন। তাই স্ত্রী ও ছেলেকে বিষাক্ত কোনো কিছু খাইয়ে পরে নিজে আত্মহত্যা করেছেন।

পুলিশের মিরপুর জোনের সহকারী কমিশনার খায়রুল আমিন সাংবাদিকদের বলেন, আজ দুপুরে এই বাড়ির মালিকের ভাই পুলিশকে জানান, বায়েজিদ যে ফ্ল্যাটে থাকেন, সেটির দরজা বন্ধ। ভেতর থেকে কেউ সাড়া দিচ্ছেন না। দরজাও কোনোভাবে খোলা যাচ্ছে না। এরপর পুলিশের উপস্থিতিতে দরজা ভাঙা হয়। ভেতরে দেখা যায়, ফ্ল্যাটের একটি কক্ষে বিছানার ওপর একজন নারী ও ১৭ বছর বয়সী একটি ছেলে পড়ে আছেন। ওই কক্ষের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় ছিলেন বায়েজিদ। তিনজনকেই মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল।

এসি খায়রুল আমিন বলেন, সিআইডির ক্রাইম সিন ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করেছে। এটি হত্যা বা অন্য কোনো ঘটনা কি না, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের পর জানা যাবে। তিনটি লাশের মুখে সাদা তরলজাতীয় পদার্থ দেখা গেছে। এটি বিষজাতীয় কিছু হতে পারে। তবে পরীক্ষা ছাড়া নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না।

এসি খায়রুল আমিন বলেন, যে ফ্ল্যাটে ঘটনাটি ঘটেছে, সেটির প্রতিটি কক্ষে অসংখ্য চিরকুট পাওয়া গেছে। তাতে মনে হচ্ছে, উনি (বায়েজিদ) খুব হতাশ ছিলেন। যে ব্যবসা করতেন, তাতে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। অনেকে ঋণের টাকা চাইতে বাসায় আসতেন। এই চাপ সহ্য করতে না পেরে হয়তো ঘটনাটি ঘটিয়ে থাকতে পারেন। কারণ, চিরকুটগুলোতে বারবার লেখা হয়েছে ‘উই আর ভেরি সরি। এই ঘটনার জন্য অন্য কেউ দায়ী নয়।’ ‘উই আর ভেরি সরি। আমাদের এমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না।’

স্বজনেরা জানান, বায়েজিদের বাবা এস এম কাশেম বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার ছিলেন। তাঁর চার ছেলে, এক মেয়ের মধ্যে বায়েজিদ ছিলেন চতুর্থ। এস এম কাশেম বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার একজন সাক্ষী ছিলেন। তাঁর বাড়ি মিরপুর ১৩ নম্বর সেকশনের সি ব্লকের ২ নম্বর সড়কে। তবে বায়েজিদ দীর্ঘদিন ধরে স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে ফ্রান্সপ্রবাসী ভায়রা আফসারুদ্দিন ব্যাপারীর বাসার তৃতীয় তলায় ভাড়া থাকতেন। পরিবারের অন্য সদস্যরাও বেশ সচ্ছল। পড়াশোনা শেষ করে বায়েজিদ তৈরি পোশাকের ব্যবসা করছিলেন। মিরপুর ১৩ নম্বর সেকশনে ‘সাইন টেক্স’ নামে তাঁর তৈরি পোশাকের একটি কারখানাও আছে। কিন্তু লোকসানের কারণে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করতে পারতেন না। সম্প্রতি ১১ লাখ টাকা বেতন বকেয়া পড়েছিল। তবে সেই টাকা তাঁর ভাইয়েরা শোধ করেন।

বায়েজিদের ভায়রা মুরাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কোহিনুর পারভিনের বাবা এম এ কুদ্দুস সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। তার পাঁচ মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে পারভিন ছিলেন সবার ছোট।

এস এম বায়েজিদের বন্ধুবান্ধবেরা জানান, পড়াশোনা শেষ করে বায়েজিদ ব্যবসা শুরু করেন। তবে তিনি যে ব্যবসাই শুরু করতেন, সেটাতেই লোকসানের মুখে পড়তেন। কারণ, তিনি নিজে ব্যবসা তদারক করতেন না। অফিসের লোকজন বা অন্যদের ওপর ভরসা করে ব্যবসা চালাতেন। বায়েজিদ ঘোরাফেরা, খাওয়াদাওয়া পছন্দ করতেন। তাঁর কোনো বদভ্যাস ছিল না। সপরিবার সিলেট ঘুরে ৮ আগস্ট ঢাকায় ফেরেন বায়েজিদ। এরপর এলাকায় বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দেন। তখনো তাঁর মধ্যে কোনো ধরনের হতাশার ভাব দেখেননি।