বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ফেনী নদীর পানি নিয়েছে ভারত

ফেনী নদীর মুহুরী প্রকল্প এলাকা। গতকাল ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায়।  ছবি: প্রথম আলো
ফেনী নদীর মুহুরী প্রকল্প এলাকা। গতকাল ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায়। ছবি: প্রথম আলো

ত্রিপুরার সাবরুম পানি প্রকল্পের জন্য সমঝোতা স্মারক সইয়ের আগে থেকেই ভারত ফেনী নদী থেকে পানি নিয়েছে। দুই দেশের মধ্যে একধরনের বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী পাম্প দিয়ে ফেনী নদী থেকে পানি নিয়েছে ভারত। তেমনি প্রয়োজন অনুযায়ী বাংলাদেশও ফেনী নদীর পানি নিয়েছে। ২০০০ সালের শুরুতে ভারতের পানি তোলা নিয়ে আপত্তি তোলে বাংলাদেশ। এরপর ২০০৫ সালে ভারত প্রথমবারের মতো দেশটির ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুম প্রকল্পের জন্য পানি দিতে বাংলাদেশকে অনুরোধ জানায়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফরে ফেনী থেকে ত্রিপুরার সাবরুম এলাকার সুপেয় পানি প্রকল্পের জন্য ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি দেওয়ার বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়। তবে এই সফরে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি। এরপরও ভারতকে ফেনী নদীর পানি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশের রাজনীতিতে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। সমালোচকদের যুক্তি হচ্ছে, ভারতের অগ্রাধিকারগুলোকে বাংলাদেশ সব সময় গুরুত্ব দিয়েছে ও দিচ্ছে। সেই তুলনায় বাংলাদেশের চাওয়াগুলো বছরের পর বছর অপূর্ণ থাকছে। বিষয়টি নিয়ে পররাষ্ট্র ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে বলেন, ফেনী নদী থেকে ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশও প্রয়োজনের সময় পানি তুলেছে। 

>ফেনী নদী থেকে ভারতের পানি তোলা নিয়ে ২০০০ সালের শুরুতে আপত্তি তোলে বাংলাদেশ

অভিন্ন নদীতে দুই দেশেরই অধিকার থাকে বলে জানান যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) কর্মকর্তারা। তাঁরা বলেন, দুই দেশই বিভিন্ন সময়ে নিজেদের প্রয়োজনে ফেনী নদী থেকে পানি নিয়েছে।

ফেনী নদীর পানি প্রসঙ্গে ৯ অক্টোবর গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, খাগড়াছড়ির রামগড়ের কাছে ফেনী নদীর ওপাশে ভারতের মানুষের খাওয়ার পানির অভাব। সেখান থেকে সামান্য পানি দেওয়া হবে। ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি। এর পরিমাণ অত্যন্ত নগণ্য। এটা নিয়ে হঠাৎ কিসের এত প্রশ্ন? কেউ যদি পানি পান করতে চায়, সেটা যদি না দেওয়া হয়, তা কেমন হবে? তিস্তার পানি চুক্তি নিয়ে আলোচনা অব্যাহত আছে জানিয়ে তিনি বলেন, তিস্তা ছাড়া সাতটি অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগির ব্যাপারেও আলোচনা চলছে।

যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফেনীসহ সাতটি অভিন্ন নদীর অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি সইয়ের জন্য দুই দেশ কাজ করছে। চুক্তি হলে ফেনী নদী থেকে ভারতের জন্য প্রতিশ্রুত ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানির পরিমাণ সমন্বয় করা হবে। অর্থাৎ স্বাভাবিক নিয়মে নদীর প্রবাহের জন্য একটি অংশ রেখে বাকি পানি দুই দেশের মধ্যে ভাগ করা হবে।

প্রায় এক দশক বিরতির পর এ বছরের আগস্টে ঢাকায় আলোচনায় বসেছিলেন বাংলাদেশ ও ভারতের পানিসম্পদ সচিবেরা। তাঁদের আলোচনায় ত্রিপুরার জন্য ফেনী নদী থেকে ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি দেওয়ার বিষয়টি সুরাহার প্রসঙ্গ ওঠে। তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর চুক্তি চূড়ান্ত করার কাজ এগিয়ে নিতে দুই দেশ গত ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে অভিন্ন ৫৪টি নদীর তথ্য সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

ফেনী নদীতে কী পরিমাণ পানি আছে, জানতে চাইলে যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) সদস্য কে এম আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এ মুহূর্তে ফেনীতে কী পরিমাণ পানি আছে, তার হালনাগাদ তথ্য তাঁদের কাছে নেই। পানির পরিমাণ নিয়ে দুই দেশের কাছে দুই রকম তথ্য আছে। বাংলাদেশের হিসাব অনুযায়ী, শুষ্ক মৌসুমে এখন ফেনী নদীতে পানির পরিমাণ ১০৯ কিউসেক। ভারতের হিসাব অনুযায়ী এই পরিমাণ ৪০০ কিউসেক। এই পরিস্থিতিতে ফেনীসহ সাতটি নদীর পানিপ্রবাহসহ প্রয়োজনীয় তথ্য সমন্বয়ের জন্য আগামী নভেম্বরে দিল্লিতে দুই দেশের কারিগরি কমিটির বৈঠক হবে। আশা করা যায়, ওই বৈঠকের পর নদীর পানিপ্রবাহসহ প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো চূড়ান্ত করার কাজ এগিয়ে যাবে।

ভারতের জন্য ফেনী নদীর পানি দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে দিল্লির একটি কূটনৈতিক সূত্র গতকাল সোমবার এই প্রতিবেদককে জানান, সাবরুমের লোকজনের পানির সংকট রয়েছে। মানবিক দিকটিকে বিবেচনায় নিয়ে যে সাবরুমের জন্য পানি দেওয়া হয়েছে, সেটি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট করেই বলেছেন। আর যে পানি দেওয়া হচ্ছে, তার পরিমাণ খুবই সামান্য।

আলোচনায় সাবরুম প্রকল্প

যৌথ নদী কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে দুই দেশের কারিগরি কমিটির বৈঠকে ও মার্চে পানিসম্পদ সচিবদের বৈঠকে সাবরুম প্রকল্পের জন্য পানি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। পরে তা বাস্তবায়িত না হওয়ায় ২০১২ সালে কারিগরি কমিটির বৈঠকে সাতটি শর্ত জুড়ে দিয়ে ভারতকে পানি প্রত্যাহার করতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সর্বশেষ গত আগস্টে ঢাকায় দুই দেশের পানিসম্পদ সচিবেরা সাত বছর আগের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।

পানি তুলে নেওয়ার অভিযোগ

দুই নিকট প্রতিবেশীর ৫৪টি অভিন্ন নদীর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ফেনী। নদীর উৎপত্তি খাগড়াছড়ির পাহাড়ে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে। ১৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ ফেনী নদী দুই দেশের সীমান্তরেখায় ৯৪ কিলোমিটার অতিক্রম করেছে। সীমান্তরেখা ধরে এটি পড়েছে বঙ্গোপসাগরে।

ফেনী নদী থেকে ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশের পানি প্রত্যাহারের বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সাইফুল হক প্রথম আলোকে বলেন, অভিন্ন নদীতে চুক্তি না থাকলে পানি প্রত্যাহারের বিষয়ে নানা রকম ধারণার জন্ম নেয়। চুক্তি থাকলে একটি রূপরেখা অনুসরণে দুই পক্ষের প্রাপ্যতা সুরক্ষিত হয়। এখন ফেনী থেকে যে পানি সাবরুমের জন্য প্রত্যাহার করা হবে, তার পরিমাণ খুবই কম। এতে পরিবেশসহ সামগ্রিক কোনো প্রভাবের তেমন আশঙ্কা নেই।

এই অধ্যাপকের মতে, আন্তসীমান্ত নদীগুলো নিয়ে যৌথ নদী কমিশনের সমীক্ষা চালানো উচিত। ওই সমীক্ষার ভিত্তিতে দুই দেশের কার কী পরিমাণ পানি প্রয়োজন, কার কী দাবি—এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে নদীবান্ধব চুক্তি হওয়া দরকার।