ছেলে বুয়েটে পড়ার সুযোগ পেলেও হলে রাখতে চান না অনেক অভিভাবক

বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা শেষে ছেলে মুরাদ মাহমুদকে সঙ্গে নিয়ে মা মাহমুদা শেরেবাংলা হলে আবরারের কক্ষটি দেখতে যান। নিরাপত্তার কারণে তাঁদের ভেতরে ঢুকতে না দেওয়ায় পেছনের জানালা দিয়ে কক্ষটির ভেতরে দেখার চেষ্টা করছেন তাঁরা। গতকাল দুপুরে।  ছবি: সাইফুল ইসলাম
বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা শেষে ছেলে মুরাদ মাহমুদকে সঙ্গে নিয়ে মা মাহমুদা শেরেবাংলা হলে আবরারের কক্ষটি দেখতে যান। নিরাপত্তার কারণে তাঁদের ভেতরে ঢুকতে না দেওয়ায় পেছনের জানালা দিয়ে কক্ষটির ভেতরে দেখার চেষ্টা করছেন তাঁরা। গতকাল দুপুরে। ছবি: সাইফুল ইসলাম

শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর থমথমে পরিস্থিতির মধ্যে গতকাল সোমবার বুয়েটে অনুষ্ঠিত হলো ভর্তি পরীক্ষা। পরীক্ষা দিতে আসা শিক্ষার্থী ও তাঁদের অভিভাবকদের চোখে–মুখে ছিল ভয় আর কষ্টের ছাপ। বুয়েটে দলীয় ছাত্ররাজনীতি বন্ধের পক্ষে তাঁরা ছিলেন উচ্চকণ্ঠ।

আবরার হত্যাকাণ্ডের পর আলোচনায় আসা র‌্যাগিং এবং নির্যাতনের ঘটনায় আতঙ্কিত ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী ও তাঁদের অভিভাবকেরা। বর্তমান পরিস্থিতিতে সন্তান বুয়েটে পড়ার সুযোগ পেলেও হলে রাখবেন না বলে জানান কয়েকজন অভিভাবক। শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস-হানাহানির অবসান চান তাঁরা।

কয়েকজন পরীক্ষার্থী ও অভিভাবক বললেন, বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে ভালো প্রস্তুতি নিলেও শেষ মুহূর্তে ছাত্রহত্যার ঘটনায় তাঁদের মনে বেশ ভয় তৈরি হয়েছে। আবরার হত্যাকাণ্ডের পর বুয়েট কর্তৃপক্ষ ও সরকারের পক্ষ থেকে এই ভয়ের কারণগুলো দূর করতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তাঁরা আশ্বস্ত হতে পারছেন না। তাঁদের আশঙ্কা, আবরার হত্যাকাণ্ড নিয়ে চলমান আলোচনা থেমে গেলে ক্যাম্পাস পরিস্থিতি আবার আগের অবস্থাতেই ফিরে যাবে।

>আতঙ্কের মধ্যেই ভর্তি পরীক্ষা
১০ দফার পূর্ণ বাস্তবায়নে আজ থেকে আবার আন্দোলন

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মতো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতির কোনো প্রয়োজন নেই বলে মন্তব্য করেন কোনো কোনো অভিভাবক। অবশ্য অভিভাবকদের কারও কারও মত, দলীয় ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করলেও বুয়েটে গঠনমূলক ছাত্ররাজনীতি থাকার প্রয়োজন আছে। তা না হলে শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো উপেক্ষিত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বুয়েটের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ইউকসু) ও হল সংসদগুলো নির্বাচনের মাধ্যমে সচল করার আহ্বান জানান তাঁরা।

গতকাল বুয়েট ক্যাম্পাসে অনেক অভিভাবকের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। এখানে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তকে তাঁরা স্বাগত জানিয়েছেন। তবে শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো যাতে উপেক্ষিত না থাকে, সে জন্য বুয়েট কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ইউকসু) ও হল সংসদগুলো নির্বাচনের মাধ্যমে সচল করার আহ্বান জানান তাঁদের কেউ কেউ।

রাজধানীর একটি কলেজ থেকে এইচএসসিতে সর্বোচ্চ ফলাফল নিয়ে বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসেছিলেন রায়হান ইসলাম। সঙ্গে ছিলেন তাঁর বাবা শামসুল ইসলাম ও মা মনোয়ারা বেগম। প্রথম ধাপের পরীক্ষার পর ছেলেকে নিয়ে পলাশীর বুয়েট মার্কেটে আসেন তাঁরা। চাকরিজীবী শামসুল ইসলাম বললেন, ‘ছেলে বুয়েটে পড়বে, অন্য অনেক অভিভাবকের মতো এই স্বপ্ন আমাদেরও। তবে আবরার হত্যার ঘটনা আমাদের আতঙ্কিত করেছে। ছেলে বুয়েটে পড়ার যদি সুযোগ পায়ও, হলে রাখতে চাই না।’

মা মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘আবরারের মায়ের মতো অন্য কোনো মায়ের কোল এভাবে খালি হোক, তা চাই না। আবরার হত্যার সঠিক বিচার করা হোক, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এমন ঘটনা ঘটানোর সাহস না পায়।’ আর ছেলে রায়হান বললেন, আবরার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তাঁরও ভয় লাগছে।

আজ থেকে ফের আন্দোলন

ভর্তি পরীক্ষার কারণে আন্দোলন দুই দিন শিথিল করেছিলেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। ১০ দফা দাবির পূর্ণ বাস্তবায়নে আজ মঙ্গলবার সকাল থেকে ফের আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছেন তাঁরা। বুয়েটের ছাত্রী অন্তরা মাধুরী গতকাল সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘১০ দফা দাবির পূর্ণ বাস্তবায়নে কাল (আজ মঙ্গলবার) থেকে আবার আমাদের আন্দোলন শুরু হবে। কাল আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের পরবর্তী বক্তব্য জানাব।’

এদিকে গতকাল সকাল থেকে দুই ধাপে বুয়েটের প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ১ হাজার ৭ আসনের বিপরীতে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন প্রায় ১২ হাজার শিক্ষার্থী। প্রথম ধাপে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা ও দ্বিতীয় ধাপে বেলা ১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত এই পরীক্ষা হয়।

ভর্তি পরীক্ষা উপলক্ষে গতকাল সকাল থেকেই ভর্তি–ইচ্ছুক শিক্ষার্থী ও তাঁদের অভিভাবকেরা বুয়েট ক্যাম্পাসে আসতে থাকেন। এর মধ্যেই বুয়েট শহীদ মিনারের সামনে সাধারণ ব্যানারে কর্মসূচি পালিত হয়। আবরার হত্যার বিচারের দাবিতে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করেন শিক্ষার্থীরা।

এক শিক্ষার্থী বলেন, সংগৃহীত গণস্বাক্ষর তাঁরা বুয়েট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন। বুয়েট কর্তৃপক্ষ সব দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দিলেও আবার কেন আন্দোলন—জানতে চাইলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী সাইদুল আরাফাত বলেন, মেনে নেওয়ার ঘোষণা আর বাস্তবায়ন এক নয়। শিক্ষার্থীরা কেবল আশ্বাস নয়, বাস্তবায়নও দেখতে চান।

 ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করেন শাখা ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী। এ ঘটনায় ১৯ জনকে (সবাই বুয়েট থেকে সাময়িক বহিষ্কৃত) আসামি করে মামলা হয়। তাঁদের মধ্যে ১৫ জনকে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এজাহারভুক্ত আরও চার আসামি পলাতক। এর বাইরে তদন্তের ভিত্তিতে পুলিশ আরও চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে। 

পুলিশের সংবাদ সম্মেলন, বহিষ্কার অমিত

ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আবরারকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। আবরার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া চার আসামির আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে এই তথ্য উঠে এসেছে বলে গতকাল জানিয়েছে পুলিশ। আর ওই ঘটনায় জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়ে গতকাল বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহাকে স্থায়ী বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।

গতকাল ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, তদন্ত শেষে নভেম্বরের শুরুর দিকে আদালতে আবরার হত্যা মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হতে পারে।

পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম বলেন, শিবির সন্দেহে পেটানোর একপর্যায়ে আবরারের মৃত্যু হয়। গ্রেপ্তার শিক্ষার্থীদের কারও কারও জবানবন্দিতে এসেছে, কয়েক ঘণ্টা ধরে তাঁকে মারধর করা হয়েছে। তবে আবরারকে হত্যার উদ্দেশ্যে মারপিট করা হয়েছে, নাকি মারপিটের জন্য মারপিট করা হয়েছে, তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ শেষে সে ব্যাপারে জানা যাবে।

এদিকে আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে দুই সদস্যের কমিটি করেছিল ছাত্রলীগ। কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সোমবার রাতে ১১ জনকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। গতকাল কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ‘কমিটির “অধিকতর তদন্তে” বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের নেতা অমিত সাহার এই হত্যার ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলেছে। অমিত সাহা ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থাকলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কথোপকথনের মাধ্যমে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। অধিকতর তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে ছাত্রলীগ থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হলো।’

আরেক আসামির স্বীকারোক্তি

আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক (বহিষ্কৃত) মেহেদী হাসান ওরফে রবিন গতকাল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। মেহেদী পঞ্চম ব্যক্তি হিসেবে স্বীকারোক্তি দিলেন। 

মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, আবরারকে মেরে হল থেকে বের করে দেওয়ার পরিকল্পনা ঘটনার চার–পাঁচ দিন আগে শেরেবাংলা হলের ক্যানটিনে বসে করা হয়েছিল বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন মেহেদী। তাঁর দাবি, ঘটনার দিন তিনিই প্রথম আবরারকে চড়–থাপ্পড় মেরেছিলেন। এরপর বাকিরা তাঁকে পেটান।