নওগাঁয় সংকটে চালকলশিল্প

নওগাঁ
নওগাঁ

নওগাঁর প্রায় ৯০ শতাংশ জমিতেই ধান চাষ হয়ে থাকে। বেশি পরিমাণ ধান উৎপাদিত হওয়ায় স্থানীয় লোকজন গর্ব করে নওগাঁ জেলাকে ‘ধানের রাজধানী’ বলেন। এখানকার অর্থনীতিও ধাননির্ভর। এই জেলায় রয়েছে দুই সহস্রাধিক চালকল। বর্তমানে ধানচাষি ও চালকল মালিক—কেউই ভালো নেই।

চালকল ব্যবসায়ীরা বলছেন, ধান-চালের দাম ক্রমাগত নিম্নমুখী। ফলে যাঁরা ধান কিনেছেন, তাঁরা সেগুলো প্রক্রিয়াজাত করতে পারছেন না। প্রক্রিয়াজাত করলেও উৎপাদন খরচের তুলনায় বাজারে চালের দাম কম হওয়ায় তাঁরা চাল বাজারজাত করতে পারছেন না। ফলে টাকা আটকে রয়েছে। ব্যবসায় ক্রমাগত মন্দার কারণে এবং গুদামে প্রচুর চাল মজুত রয়ে যাওয়ায় অধিকাংশ চালকলমালিক উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছেন। এ ছাড়া রয়েছে ব্যাংকঋণের চাপ। ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে অনেক চালকলমালিক খেলাপি হয়ে পড়েছেন। 

জেলা চালকল মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, এ জেলায় ১ হাজার ২০০ চালকল রয়েছে। এগুলোর মধ্যে স্বয়ংক্রিয় চালকল ৫৫, বাকি ১ হাজার ১৪৫টি হাসকিং মিল (পুরোনো ম্যানুয়াল পদ্ধতির চালকল)। বিভিন্ন মৌসুমে সরকারি গুদামে চাল দেওয়ার জন্য চালকলমালিকেরা লাইসেন্স নবায়ন করলেও বর্তমানে কার্যত ৯৫ শতাংশ হাসকিং মিলের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। উৎপাদন বন্ধ থাকায় ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ শোধ করতে পারছেন না অনেক চালকলমালিক। ব্যাংকঋণ শোধ করতে না পারায় দেড় শতাধিক চালকলমালিকের বিরুদ্ধে ঋণখেলাপির মামলা হয়েছে।

নওগাঁর ১১টি উপজেলার মধ্যে সদর ও মহাদেবপুর উপজেলাতেই ৯৫ শতাংশ চালকল অবস্থিত। গত সোমবার ওই দুই উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ হাসকিং ও স্বয়ংক্রিয় চালকল বন্ধ। মিলগুলোতে ঢুকে কথা বলার মতো কোনো লোকও পাওয়া যায়নি। 

মহাদেবপুর উপজেলার নওহাটা এলাকায় অবস্থিত রেখা চালকলের মালিক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা হাসকিং মিলের মালিকেরা খুব বিপদে আছি। ব্যবসা মন্দার কারণে আমি দুই বছর ধরে শুধু সরকারি বরাদ্দের চাল উৎপাদনের জন্য বছরে মাত্র ১৫ থেকে ২০ দিন মিল চালু করি। এ ছাড়া সারা বছরই মিল বন্ধ থাকে। আমার মতো সিংহভাগ হাসকিং মিলের এই অবস্থা।’

সদর উপজেলার হাঁপানিয়া এলাকার মৌসুমি চালকলের মালিক রিজভী আহমেদ বলেন, ‘তিন বছর আগে ব্যাংক থেকে ৫০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলাম। ব্যবসায় ক্রমাগত মন্দার কারণে এক বছর ধরে মিলে চাল উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছি। ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ব্যাংকঋণও শোধ করতে পারিনি। মাস তিনেক আগে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। লাভের আশায় চাল ব্যবসা করতে এসে এখন আমি সর্বস্বান্ত।’

মহাদেবপুর উপজেলার সরস্বতীপুর এলাকার মেসার্স রাজ্জাক চালকলের মালিক রাজ্জাক মণ্ডল বলেন, স্বয়ংক্রিয় চালকলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারায় এবং ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহারের কারণে তাঁদের মতো ছোট ছোট চালকলমালিক পুঁজি হারিয়ে ফেলছেন। ফলে লোকসান ঠেকাতে তাঁরা মিলের উৎপাদন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

নওগাঁ শহরের ভবানীপুর এলাকায় অবস্থিত মেসার্স শাপলা অটো রাইস মিলের মালিক জাহিদ হোসেন বলেন, আর দেড়-দুই মাস পরেই নতুন ধান উঠবে। অথচ বিক্রি করতে না পারায় গত মৌসুমের আমন ও বোরো চাল তাঁর গুদামে এখনো পড়ে আছে। বর্তমানে বাজারে চালের যে দাম, তাতে এখন বিক্রি করলে বড় অঙ্কের লোকসান গুনতে হবে। লাভ না হোক, উৎপাদন খরচ তুলতে পারলেও তিনি চাল বিক্রি করে দেবেন। এই অবস্থার পরিবর্তন না হলে অন্যদের মতো তাঁকেও মিল বন্ধ করে দিতে হবে।

চালকলমালিক এবং পাইকারি ও খুচরা চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চার মাস আগে বোরো সংগ্রহের শুরুতে প্রতি কেজি ‘জিরা’ চালের দাম ছিল ৪৮-৫০ টাকা। সেই চালের দাম কমতে কমতে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৩৬-৩৮ টাকায়। মিনিকেট চালের দামও কেজিতে ১০-১২ টাকা করে কমে ৩৪-৩৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ‘গুটি স্বর্ণা’ চালের দাম ৮-১০ টাকা কমে বর্তমানে ২৪-২৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

নওগাঁ আলুপট্টি চাল মোকামের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী সঞ্জয় কুমার বলেন, এ বছর চালের বাজারে কোনো স্থিতিশীলতা নেই। চালের দাম ক্রমাগত কমছে। এ ছাড়া মোকামগুলোও প্রায় ক্রেতাশূন্য। অন্য বছর এই সময়ে (বোরো ও আমনের মাঝামাঝি) চালের দাম সাধারণত বাড়ত। কিন্তু এবার উল্টো দাম কমছে।

জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন বলেন, চালকলমালিকেরা ভালো না থাকলে কৃষকেরাও ভালো থাকবেন না, এটাই স্বাভাবিক। সরকারের ভুল নীতির কারণে এই শিল্প আজ ধ্বংস হতে বসেছে। এই শিল্পকে বাঁচাতে না পারলে কৃষকও বাঁচবেন না।

সম্প্রতি নওগাঁয় এক মতবিনিময় সভায় নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের পক্ষে সরকারের কাছে ১০টি সুপারিশ তুলে ধরা হয়। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সারা দেশের সব শ্রেণির মিলের উৎপাদন ক্ষমতা অনুযায়ী সঠিকভাবে বরাদ্দ নির্ধারণ করতে হবে, ব্যাংকঋণের সুদের হার এক ডিজিটে আনতে হবে, ঋণখেলাপিদের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার বাস্তবায়ন করতে হবে এবং চালকলকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।

জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, বর্তমান সময়ে কৃষক ও চালকলমালিক—কোনো পক্ষই ভালো নেই। স্বল্প আমদানি শুল্কের সুযোগে ২০১৭ সাল থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিপুল পরিমাণ চাল আমদানি হয়েছে। এর প্রভাব এখনো বাজারে রয়ে যাওয়ায় ধান-চালের দাম নিম্নমুখী। ব্যাংকঋণের সুদের হার না কমালে এবং সরকারের সংগ্রহ মৌসুমে ২০ শতাংশ ধান এবং ৮০ শতাংশ চাল সংগ্রহের ব্যবস্থা প্রবর্তন না করলে আগামী আমন মৌসুমেও এর প্রভাব পড়বে।