দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর হুমকি-ধমকিতে দিশেহারা ঢাকার মিরপুর-কাফরুলবাসী

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর হুমকি–ধমকিতে দিশেহারা ঢাকার মিরপুর ও কাফরুল এলাকার অনেক মানুষ। একজন শাহাদত হোসেন ওরফে শাহাদত। তিনি ফাঁসির আসামি। ভারতে অবস্থানরত শাহাদত প্রতিনিয়ত বিভিন্ন পেশার মানুষের কাছে চাঁদা চেয়ে হুমকি দিচ্ছেন। শাহাদতের ভয়ে ভুক্তভোগীরা নীরবে চাঁদা দিচ্ছেন। আরেক সন্ত্রাসী শাহীন শিকদার। চাঁদা নিতে গিয়ে তিনি মানুষ পর্যন্ত খুন করেন। এই দুই সন্ত্রাসী রাজধানীতে এখন পুলিশ ও র‌্যাবের মাথাব্যথার কারণ।

পুলিশ ও র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, ঢাকায় পেশাদার সন্ত্রাসীরা শাহাদতের সহযোগী হিসেবে কাজ করে। গত দেড় যুগে শাহাদত ও তাঁর বাহিনীর হাতে ৩০ জনের মতো মানুষ খুন হয়েছেন। পঙ্গু হয়েছেন অনেকে। নিয়মিত চাঁদা পেতে তিনি তাঁর কয়েক সহযোগীকে ভারত থেকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন। এঁদের একজন ‘ব্যাঙা বাবু’ র‌্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।

শাহীন শিকদারও কম যান না। তিনি চাঁদার জন্য কাফরুলে গুলি করে মানুষ হত্যা করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে কাফরুল থানায় হত্যা, চাঁদাবাজিসহ আটটি মামলা রয়েছে।

সন্ত্রাসী শাহাদত যে নম্বর থেকে বিভিন্নজনের কাছে ফোন করেছেন, তা পুলিশ ও র‌্যাব কর্মকর্তারা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছেন, তিনি ভারত আছেন। আর শাহীন শিকদার ঢাকাতেই আছেন। মিরপুরে ওয়ার্ড কমিশনার ছাইদুর রহমান ওরফে নিউটন ও আওয়ামী লীগ নেতা মনু হত্যা মামলায় শাহাদতের ফাঁসির সাজা হয়েছে। পুলিশ ও র‌্যাব শীর্ষ এই দুই সন্ত্রাসীর সহযোগীদের ধরতে রাজধানীতে পুরোদমে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এঁদের দু-একজন ধরা পড়লেও অধিকাংশ থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে র‌্যাব-৪–এর উপ–অধিনায়ক মেজর কাজী সাইফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, আগে সন্ত্রাসী শাহাদত চাঁদার জন্য খুনখারাবি করে আতঙ্ক ছড়াতেন। এখন ফোনে হুমকি দিলেই ভয়ে ব্যবসায়ীরা নীরবে দুর্ধর্ষ এই সন্ত্রাসীর সহযোগীদের হাতে চাঁদার টাকা তুলে দিচ্ছেন। মিরপুরের বিভিন্ন মার্কেটে শাহাদত এবং কচুক্ষেতসহ কাফরুলের বিভিন্ন এলাকায় শাহীন শিকদারের সহযোগীরা চাঁদাবাজি করছেন। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে এর আগে এই সন্ত্রাসীর অনেক সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

সম্প্রতি সরেজমিনে মিরপুর–১ নম্বরের মুক্ত বাংলা শপিং কমপ্লেক্স, মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটসহ কয়েকটি বিপণিবিতান এবং কচুক্ষেতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে ওই তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেছে। তবে তাঁরা নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।

মিরপুরের এক ব্যবসায়ী বলেন, কয়েক বছর আগে শাহাদতকে চাঁদা না দেওয়ায় তাঁর পরিবারের এক সদস্যকে হারাতে হয়েছে। তাই তিনি নিজে, পরিবার ও ব্যবসার স্বার্থে প্রতি মাসে শাহাদতকে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের চাঁদা দিয়ে যাচ্ছেন।

র‌্যাবের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, কয়েকজনের কাছ থেকে ঠিকমতো চাঁদা না পেয়ে শাহাদত ভারত থেকে তাঁর বিশ্বস্ত কয়েকজন সহযোগীকে দেশে পাঠিয়েছিলেন খুন করার জন্য। তাঁদের মধ্যে ব্যাঙা বাবু মিরপুর বেড়িবাঁধে র‌্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।

কে এই শাহাদত

শাহাদত একসময় শাহ আলী থানা ছাত্রলীগের সহসভাপতি ছিলেন। শাহ আলী এলাকার শাইনপুকুর রোডে স্থায়ী বাস ছিল। তাঁর বাবা নুরুজ্জামান ছিলেন টিঅ্যান্ডটির কর্মচারী। শাহাদত ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত মিরপুরে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তেজগাঁও কলেজে ভর্তি হলেও এইচএসসি পাস করতে পারেননি। ১৯৯৮ সালে গুদারাঘাট এলাকায় একটি খুন করে প্রথম আলোচনায় আসেন তিনি। এরপর অপরাধজগতে পা রেখে একের পর এক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ২০০৫ সালে মিরপুরের ব্যবসায়ী আফতাব উদ্দিনকে খুন করে তিনি ভারতে পালিয়ে যান বলে অভিযোগ আছে। এরপর থেকে তিনি সেখানেই আছেন। দুটি মামলায় তাঁর মৃত্যুদণ্ডের সাজা হয়েছে। আরও ১৩টি মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।

শাহীন শিকদারের চাঁদাবাজি

দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী শাহীন শিকদারের বিরুদ্ধে কাফরুল থানায় খুন, চাঁদাবাজিসহ আটটি মামলা আছে। চাঁদাবাজিতে শাহীন শিকদারের ৩০ সহযোগী সক্রিয় আছেন। শাহীন শিকদার ছিলেন কাফরুল এলাকা নিয়ন্ত্রণকারী আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী কিলার আব্বাসের ডান হাত। কিলার আব্বাস কারাগারে গেলে শাহীন শিকদার সেই অবস্থানে নিজেকে পাকাপোক্ত করেন।

সম্প্রতি শাহীন শিকদার কচুক্ষেতে বেসরকারি হাইটেক মাল্টিকেয়ার হাসপাতাল লিমিটেডে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা চেয়ে হুমকি দিয়েছিলেন। তাঁর হুমকিতে হাসপাতালের কয়েকজন চিকিৎসক চেম্বার ছেড়ে দেন।

হাসপাতালটির অন্যতম মালিক মো. সাইফুল্লাহ সাদেক প্রথম আলোকে বলেন, শাহীন শিকদার একবার নয়, কয়েকবার তাঁর কাছে চাঁদা চান। শাহীন হুমকি দিয়ে বলেন, হাসপাতাল চালাতে হলে এককালীন ৫০ লাখ এবং প্রতি মাসে ১০ লাখ করে টাকা দিতে হবে। এ ব্যাপারে তিনি কাফরুল থানায় জিডি করেছেন এবং র‌্যাব-৪–এর কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। 

শাহীন শিকদারের সহযোগীরা চাঁদা না পেয়ে ছয়-সাত মাস আগে কচুক্ষেতের বৈদ্যুতিক সামগ্রী ব্যবসায়ী আজাদ হোসেনকে গুলি করেন। ভয়ে তিনি মামলা করেননি।

পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে কচুক্ষেতের আল আমিন বেডিং স্টোরের মালিক আবুল কালামকেও প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। আবুল কালাম বলেন, ভয়ে শাহীন শিকদারের বিরুদ্ধে তিনি থানা-পুলিশ কিংবা র‌্যাবকে জানান। এখনো তাঁর দিন কাটছে আতঙ্কে।

কাফরুল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সেলিমুজ্জামান বলেন, শাহীন শিকদার কাফরুল থানার তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। তাঁকে খুঁজছে পুলিশ। 

পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার মো. মোস্তাক আহমেদ বলেন, ‘যাঁদের কাছে চাঁদা চায়, তাঁরা আমাদের জানালে তাঁর নাম–পরিচয় গোপন রেখে সন্ত্রাসী শাহাদতের সহযোগীদের গ্রেপ্তারে কাজ করা হবে। আর সন্ত্রাসী শাহীন শিকদারকে ধরতে পুলিশ একইভাবে কাজ করবে।’