বাঁধের জলে জাল পড়ে ঝপাৎ

শুক নদের বুড়ির বাঁধ (জলকপাট) খুলে দেওয়ার পর মাছ ধরতে নেমে পড়েন মানুষ। গতকাল সকালে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলায়।  প্রথম আলো
শুক নদের বুড়ির বাঁধ (জলকপাট) খুলে দেওয়ার পর মাছ ধরতে নেমে পড়েন মানুষ। গতকাল সকালে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলায়। প্রথম আলো

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে সবে। কুয়াশায় মোড়ানো ভোরে নদীর পাড়ে জড়ো হতে শুরু করেছে মানুষ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে মানুষের ভিড়। সবার কাঁধে ফিকা জাল, খইয়া জাল, খলইসহ মাছ ধরার নানা উপকরণ। তাঁরা সবাই এসেছেন ছোট-বড় নানা প্রজাতির মাছের টানে।

গতকাল শনিবার ভোর সাড়ে ছয়টার দিকে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার শুক নদের ওপরের বুড়ির বাঁধ (জলকপাট) এলাকার চিত্র এটি।

প্রতিবছর অক্টোবর মাসের এ সময়ে খুলে দেওয়া হয় জলকপাটের দরজা। পানি কমে গেলে বাঁধে আটকে থাকা পানিতে নেমে পড়েন এলাকার মানুষ। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন আশপাশের শহর-গ্রামের মানুষজনও। তা একসময় রূপ নেয় মাছ ধরার উৎসবে। ছেলে-বুড়ো সবাই গা ভাসান এ উৎসবে।

শুক্রবার বিকেলে জলকপাটের দরজা খুলে দেওয়া হয়। পানি কমে গেলে গতকাল ভোর থেকে স্থানীয় ও আশপাশের লোকজন মাছ ধরতে
শুরু করেন। মাছ ধরার এ উৎসব চলবে আরও দু-তিন দিন।

এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, শুষ্ক মৌসুমে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আকচা, আখানগর ও চিলারং ইউনিয়নের কৃষিজমিতে সেচসুবিধার জন্য ১৯৮২ সালে সীমানার শুক নদের ওপর বুড়ির বাঁধ নামে একটি জলকপাট (স্লুইসগেট) নির্মাণ করা হয়। জলকপাটে আটকে থাকা পানিতে প্রতিবছর মৎস্য অধিদপ্তর বিভিন্ন জাতের মাছের পোনা ছাড়ে। এ বছর মৎস্য অধিদপ্তর মাছের সাড়ে ১৭ কেজি রেণু ছেড়েছে। আর এ পোনাগুলো যাতে কেউ ধরতে না পারে, তা দেখভাল করেছে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ।

এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে এ উৎসবের রেওয়াজ চলে আসছে। আর এসব মাছ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হলে সেখানে চলে মাছ ধরার উৎসব।

গতকাল ভোর সাড়ে ছয়টার দিকে বুড়ির বাঁধ এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, শত শত মানুষ হাতে জাল, খইয়া জাল ও মাছ রাখার খলই নিয়ে জলকপাটের পানিতে দাঁড়িয়ে জাল ফেলে মাছ ধরছেন। চারদিকে শুধু পানিতে জাল ফেলার ঝপাৎ ঝপাৎ শব্দ। আর বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে তাঁদের উৎসাহ দিচ্ছেন তাঁদের বন্ধুবান্ধব ও স্বজনেরা। কারও জালে বড় মাছ ধরা পড়লে সবাই চিৎকার করে তাঁকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন।

সে সময় চিলারং গ্রামের আবদুল ওহাবের জালে ধরা পড়ে তিন কেজি ওজনের একটি বিগহেড মাছ। মাছটি পেয়ে তিনি জালসহ বুকে জড়িয়ে পাড়ে উঠে আসেন। তিনি বলেন, ‘অনেক চেষ্টার পর একটা বড় মাছ পেলাম। আজ এটা পরিবারের সবাই মিলে খাব।’

বাঁধের দুই পাশে বসেছে খাবারের হোটেল, ফলের দোকান, খেলনার দোকান। এলাকার লোকজন বিভিন্ন এলাকা থেকে উৎসবে যোগ দেওয়া মানুষজনের মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল নিরাপদে রাখার জন্য তৈরি করেছেন গ্যারেজ।

ধরা পড়া মাছ কেনার জন্য সেখানে ভিড় করেছেন পাইকারেরা। তাঁরা এলাকার মানুষের কাছ থেকে মাছ কিনে সেগুলো বাঁধের ওপর বিক্রি করছেন। আর শহর থেকে আসা উৎসুক মানুষগুলো সেই মাছ দর-কষাকষি করে কিনে নিচ্ছেন।

মাছের পাইকার অশোক দাস জানান, ভোর থেকে মাছ কিনতে শুরু করেছেন। এ পর্যন্ত ১৮ হাজার টাকার ছোট মাছ কিনেছেন। আর সেগুলো সরবরাহ করছেন শহরের বিভিন্ন বাজারে। এ থেকে তাঁর বেশ লাভ হবে বলে তিনি আশা করছেন।

মাছ ধরতে আসা আখানগর গ্রামের হারুন অর রশিদ বলেন, ‘প্রতিবছর আমরা এ দিনটির জন্য অপেক্ষা করে থাকি। প্রহর গুনি কবে স্লুইসগেট মাছ ধরার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। সকালে থেকে দুপুর পর্যন্ত চার-পাঁচ কেজি ছোট-বড় মাছ ধরেছি। আত্মীয়স্বজনকে বিতরণের পর যা থাকবে, তা বাড়ির সবাই খাব।’

আকচা গ্রামের জীতেন শর্মা জানান, এই বাঁধে বোয়াল, বাইম, গুতুম, শোল, ট্যাংরা, ভেদার, খলসে, পুঁটি, টাকি, মলা, চিংড়িসহ দেশি নানান জাতের মাছ বেশি পাওয়া যায়। তবে অনেকের জালে আবার রুই, কাতলা, বিগহেড মাছও ধরা পড়ে।

ঠাকুরগাঁও শহরের হাজিপাড়ার বাসিন্দা নাজমুল হুদা জানান, শহরে বাসা হলেও তিনি বন্ধুদের নিয়ে প্রতিবছর এখানে এসে মাছ ধরেন। মাছ ধরার পাশাপাশি একটু বিনোদনও হয়। আর এ ফাঁকে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়।

সদর উপজেলার আকচা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সুব্রত বর্মণ বলেন, প্রতিবছর এখানে মাছ ধরা নিয়ে উৎসব শুরু হয়। শুধু আশপাশের গ্রাম নয়, শহরের অনেক মানুষ এখানে মাছ ধরার জন্য ভিড় করেন। পানিতে যখন জাল পড়তে থাকে, এ দৃশ্য দেখে মন ভরে যায়।