ঘুরেফিরে ওসিরা ঢাকাতেই

ঢাকা মহানগরীর থানাগুলোর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওসি পদে রাজনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের অসন্তোষ ও অস্বস্তি দীর্ঘদিনের। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকায় ওসি হওয়ার মূল যোগ্যতাই হচ্ছে রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ। স্বাভাবিকভাবেই এ পন্থায় নিয়োগ পাওয়া ওসিরা কারও নির্দেশ মানতে চান না। তাঁদের বিরুদ্ধে অনিয়ম–দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও সহজে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। দিনের পর দিন তাঁরা ডিএমপিতেই কাটিয়ে দিচ্ছেন।

গত কয়েক দিনে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার থেকে পরিদর্শক পর্যন্ত বিভিন্ন পদের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব জানা গেছে।

অনেক পুলিশ কর্মকর্তা মনে করেন, ডিএমপির ওসি হওয়ার জন্য মোটাদাগে কয়েকটি যোগ্যতা লাগে। এর মধ্যে তিনটি প্রধান যোগ্যতা হচ্ছে, একটি বিশেষ এলাকায় বাড়ি হওয়া, ছাত্রজীবনে সরকারদলীয় রাজনীতিতে যুক্ত থাকা এবং আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতার লোক বলে পরিচিতি পাওয়া।

পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, ডিএমপিতে কর্মজীবনে তিনি বিভিন্ন সময় সাংসদ থেকে শুরু করে মন্ত্রীদেরও ওসি নিয়োগের তদবির করতে দেখেছেন। ডিএমপির ওসি হতে শক্ত খুঁটির জোর থাকতে হয়, দু–একটা ফোনে কিছু হয় না।

পুলিশ সুপার পদমর্যাদার আরেক কর্মকর্তা বলেন, রাজনৈতিক যোগাযোগের কারণে ওসিদের নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব কঠিন। তাঁরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মানতে চান না। আবার ওসি পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের লেনদেনের কথাও শোনা যায়।

ঢাকার গুলশান বিভাগের একটি থানার একজন কর্মকর্তা জানান, পাঁচ বছর আগে তাঁর একজন সহকর্মী একজন কর্মকর্তার স্ত্রীকে গাড়ি কিনে দিয়েছিলেন। তবে ওই সহকর্মী থানায় বেশি দিন ওসি হিসেবে থাকতে পারেননি।

নিয়ম অনুযায়ী একজন ওসি একটি থানায় দুই বছর থাকতে পারেন। কিন্তু তাঁরা কৌশলে এ থানা ও থানা করে ঢাকাতেই ৫ থেকে ১২ বছর থাকছেন। এ পদে নিয়োগ পেতে কেন এত আগ্রহ, জানতে চাইলে একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, মহল্লার অলিগলির সবজি ভ্যান থেকে শুরু করে সরকারি জমি দখলদারদের কাছ থেকে থানা–পুলিশের নামে টাকা তোলা হয়। সেই টাকার ভাগ ওসিরা পান না, এ কথা বলা যাবে না।

>

অনেক পুলিশ কর্মকর্তা মনে করেন, ডিএমপির ওসি হওয়ার জন্য মোটাদাগে কয়েকটি যোগ্যতা লাগে। এর মধ্যে তিনটি প্রধান যোগ্যতা হচ্ছে, একটি বিশেষ এলাকায় বাড়ি হওয়া, ছাত্রজীবনে সরকারদলীয় রাজনীতিতে যুক্ত থাকা এবং আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতার লোক বলে পরিচিতি পাওয়া।

তবে দক্ষিণ ঢাকার একটি থানার ওসি প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি সরকারের আমলেও ঢাকার ওসিরা রাজনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছেন। ওসিদের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে বলেই সরকারের অনুগতদের ওসি করা হয়।

ওসিনামা
গত বছরের এপ্রিলে কিশোর ছেলেকে ধরে নিয়ে হত্যার অভিযোগে ওয়ারী থানার ওসি রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছিলেন রীতা হাওলাদার নামে এক নারী। এক মাস পর তিনি পুলিশের চাপে মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। তবে রফিকুল ইসলাম এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় ২০০৯ সালে যোগ দেন ওমর ফারুক। সেখান থেকে যান মুগদা থানায়। ২০১৬ সালে তাঁকে মতিঝিল থানার ওসি করা হয়। মতিঝিল থানার আশপাশের ক্লাবগুলোতেই চলত ক্যাসিনো। ক্যাসিনো–কাণ্ডের পর তাঁকে ডিবিতে বদলি করা হয়েছে। ওমর ফারুক আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতার লোক বলে পরিচিত।

তিন বছর ধরে ডিএমপিতে আছেন মাহমুদুল হক। পল্টন থানায় ওসি হিসেবে থাকার সময় চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দিয়ে এক নারীকে ধর্ষণ করেন। সেই নারীর অভিযোগে সম্প্রতি তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

পল্লবী থানার সাবেক ওসি দাদন ফকিরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ ছিল। এ নিয়ে পুলিশের অপরাধ সভায় আলোচনাও হয়। পরে তাঁকে ডিবিতে বদলি করা হয়।

কোতোয়ালি থানার সদ্য সাবেক ওসি শাহিদুর রহমানের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি দখলে একটি পক্ষকে সহযোগিতার অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার ইব্রাহিম খান সাময়িক বরখাস্ত হন। তবে ওসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ওসিদের এসব বিষয় জেনেই নতুন ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম গত ১৫ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘থানাকে জনমুখী করতে প্রয়োজনে আমি নিজে থানায় বসে ওসিগিরি করব।’

বছরের পর বছর ডিএমপিতে
তুরাগ থানার ওসি নুরুল মোত্তাকীন এর আগে ডেমরা, ভাটারা থানায় ছিলেন। এক যুগ ধরে তিনি ঢাকা মহানগরেই আছেন। জানতে চাইলে পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার নাবিদ কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ওসির পোস্টিং দেয় কর্তৃপক্ষ। এখানে ডিসিদের কিছু করার থাকে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ডিএমপিতে দীর্ঘ সময় থাকা ওসিদের মধ্যে কাফরুল থানার ওসি মো. সেলিমুজ্জামান ১০ বছর, দক্ষিণখান থানার ওসি শিকদার মো. শামীম হোসেন ৯ বছর, বিমানবন্দর থানার ওসি নূরে আযম মিয়া ৯ বছর, বনানী থানার ওসি বি এম ফরমান আলী ৭ বছর, ভাষানটেক থানার ওসি মীর ছাব্বীর আহম্মেদ ৭ বছর, তেজগাঁও থানার ওসি শামীম অর রশীদ ৮ বছর, মতিঝিল থানার ওসি মোহাম্মদ ইয়াসির আরাফাত খান ৭ বছর, পল্টন মডেল থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক ৮ বছর, শাহ আলী থানার সালাহউদ্দিন ৬ বছর, উত্তরখান থানার হেলাল উদ্দিন ৮ বছর ডিএমপিতেই আছেন।

এভাবে বছরের পর বছর একই অঞ্চলে ওসিদের থাকা যৌক্তিক কি না, জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা ভালো তাঁদের রাখলে ক্ষতি নেই। কিন্তু যাঁদের ভাবমূর্তি ভালো না, তাঁদের অন্যত্র বদলি করা হবে।

বছরের পর বছর ওসিদের এভাবে একই ইউনিটে থাকা ঠিক কি না—জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মুহা. নুরুল হুদা বলেন, দীর্ঘকাল এক স্থানে থাকায় তাঁরা যাতে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়াতে না পারেন, সে ব্যাপারে তদারকি রাখতে হবে।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, দীর্ঘদিন এভাবে একই এলাকায় থাকার কারণে সন্ত্রাসী-মাস্তানদের সঙ্গে ওসিদের সখ্য গড়ে ওঠে। নানা রকম অনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাঁরা যে জড়িয়ে পড়ছেন, সেই প্রমাণও মিলেছে। সর্বশেষ ১ অক্টোবর ডিএমপির আট ওসিকে বদলি করা হয়। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে জুয়াড়িদের ঘনিষ্ঠতা ছিল বলে অভিযোগ উঠেছে।