বাঁদরামিতে নাজেহাল মানুষ

একটি বাড়ির দেয়ালে ঘুরে বেড়াচ্ছে বানর। সম্প্রতি মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার শাহবাজপুর স্টেশন এলাকায়।  প্রথম আলো
একটি বাড়ির দেয়ালে ঘুরে বেড়াচ্ছে বানর। সম্প্রতি মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার শাহবাজপুর স্টেশন এলাকায়। প্রথম আলো

এক পায়ে সমস্যা। তাতে কী! সুস্থ বাকি পা নিয়েই তার যত দাপট। জঙ্গল ছেড়ে লোকালয়ে এসে তাড়িয়েছে আপন জাতের শান্ত প্রতিবেশীকে। এ পর্যন্ত সাতজনকে আঁচড়ে-কামড়ে আহত করেছে। তার ভয়ে পুরো এলাকার মানুষ তটস্থ। পাশাপাশি আছে দলের অন্যরাও। এরা মানুষের ঘরে ঢুকে রান্না করা খাবার ও কাপড়চোপড় নিয়ে দৌড় দিচ্ছে। নষ্ট করছে খেতের ফসল। বানরের এই বাঁদরামিতে কাবু স্থানীয় মানুষ।

মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়নের শাহবাজপুর স্টেশন এলাকাসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামে প্রায় দুই মাস ধরে এই অবস্থা বিরাজ করছে। গভীর বন-জঙ্গল কমে আসায় আবাস, খাদ্যসংকটসহ নানা কারণে বানর লোকালয়ে আসছে বলে ধারণা করছেন স্থানীয়রা।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বড়লেখার সীমান্তবর্তী উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়নে আটটি চা-বাগান ও বনাঞ্চল রয়েছে। পাহাড় ও চা-বাগানে অনেক বানরের বাস। এরা অনেক সময় খাবারের সন্ধানে দলবলে লোকালয়ে এসে খেতের ফসল খেয়ে কিংবা নষ্ট করে চলে যায়। বছরখানেক আগে দলছুট একটি বানর আসে লোকালয়ে। এই বানর শান্ত প্রকৃতির হওয়ায় স্থানীয় মানুষও তার সঙ্গে ভালো আচরণ করেছে। খাবারদাবার দিয়েছে। পরে তার সঙ্গে আরও চার-পাঁচটি বানর যোগ দেয়। মাস ছয়েক আগে আসে একটি ল্যাংড়া বানর। এই বানরটি এসেই শান্ত স্বভাবের বানরটিকে তাড়িয়ে দিয়েছে। এরপর বাকি বানরগুলো শাহবাজপুর স্টেশন বাজার, রাজপুর, সায়পুর, পূর্ব দৌলতপুর এলাকায় ঘোরাফেরা করে।

এদিকে গত দুই মাস ধরে হঠাৎ ল্যাংড়া বানরটি মানুষের ওপর আক্রমণ শুরু করেছে। ভোরবেলা ও রাতে একা পেলেই লোকজনের ওপর হামলা করছে। গত দুই মাসে এই বানরের আক্রমণে সাতজন আহত হয়েছেন। সবশেষ ১৯ অক্টোবর ভোরে বানরের আক্রমণে আবদুল্লাহ আল মামুন (২৭) নামের এক ব্যবসায়ী আহত হয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে আহত অন্যদের মধ্যে আছেন শাহবাজপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের কনস্টেবল মাসুদ আহমদ, সায়পুর গ্রামের মাতাবুর রহমান ও আমান আহমদ, রাজপুর গ্রামের আবদুল কুদ্দুস, পূর্ব দৌলতপুর গ্রামের ছুরতুন বেগম ও স্টেশন বাজার এলাকার সুলেমান আহমদ। এতে শিশুসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। অন্য বানরগুলো দলবলে মানুষের ঘরে ঢুকে রান্না করা খাবার, খাবারের হাঁড়ি-পাতিল, কাপড়চোপড় নিয়ে দৌড় দেয়। ফসল নষ্ট করে। বানরের এই উৎপাতে বিরক্ত মানুষ। অনেকে ভোরবেলা হাঁটাহাঁটি করতেন। ভয়ে এখন ভোরে বের হন না। এ ছাড়া ইউনিয়নের আতুয়া, বড়আইল এলাকায়ও মানুষের বাড়ির ফল, খেতের সবজি এবং ধান নষ্ট করে পাহাড় থেকে নেমে আসা বানরের দল। ঘরে ঢুকে রান্না করা খাবার নিয়ে যায়।

শাহবাজপুর স্টেশন বাজারের বাসিন্দা রফিক উদ্দিন বলেন, যখন একটি বানর এসেছিল, এই বানরটি ভালো ছিল। স্থানীয় মানুষ তার পেছনে অনেক টাকা খরচ করেছে। খাবার দিয়েছে। এরপর আরও পাঁচটি বানর আসে। এর মধ্যে একটি ল্যাংড়া বানর আসে। এটি এসে ভালো বানরটিকে তাড়িয়ে দেয়। কেউ খাবার দিলেও খেত না। হঠাৎ মানুষের ওপর আক্রমণ শুরু করেছে।

উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আহমদ জুবায়ের লিটন বলেন, ‘বেশ কয়েকজনকে আহত করেছে বানর। আমরা তাৎক্ষণিক বন বিভাগকে জানিয়েছি। বন বিভাগের লোকজন আসবেন। তাঁরা বলেছেন, এদের ধরা যায় না। তাঁরা মানুষকে সচেতন করে যাবেন, যাতে বানরগুলোকে উত্ত্যক্ত না করা হয়। অনেক সময় মানুষ উত্ত্যক্ত করে। এর জন্যও হয়তো কামড় দেয়।’

বন বিভাগের বড়লেখা রেঞ্জের সহযোগী কর্মকর্তা শেখর রঞ্জন দাস বলেন, ‘স্থানীয়ভাবে খবর পেয়েছি। আমাদের অফিসে বানর ধরার কোনো যন্ত্রপাতি নেই। বিষয়টি মৌলভীবাজার বন্য প্রাণী রেঞ্জকে জানানো হয়েছে। তারা সরেজমিনে দেখে যাবে।’

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের মৌলভীবাজার রেঞ্জ কর্মকর্তা মোনায়েম হোসেন বলেন, ‘মানুষ যখন খাবার দেয়, বিরক্ত করে, তখন কামড়ায়। বন্য প্রাণীকে খাবার না দিলে তারা একসময় ফিরে যাবে। বনে খাদ্যসংকটই শুধু নয়, দলছুট হয়। হারানো সন্তানের খোঁজসহ নানা কারণে বন্য প্রাণী লোকালয়ে আসতে পারে। আমরা এলাকায় যাব, মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করব।’