ডলফিন মেলায় এক বেলা

ডলফিন মেলায় শিশুরা। আগারগাঁও, ঢাকা। ছবি: আশরাফুল আলম
ডলফিন মেলায় শিশুরা। আগারগাঁও, ঢাকা। ছবি: আশরাফুল আলম

এই শহরে তো কত ধরনের মেলাই হয়। বাণিজ্য মেলা, বৃক্ষমেলা, বস্ত্রমেলা, মৎস্যমেলা—এমন আরও কত কিছু। তাই বলে মিঠা পানির বাসিন্দা নিরীহ ডলফিন নিয়ে মেলার আয়োজন। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে বৃহস্পতিবার থেকে আন্তর্জাতিক ডলফিন (স্বাদু পানির) দিবস উপলক্ষে এমনই চমকপ্রদ এক মেলা শুরু হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শুশুক বা ডলফিন অত্যন্ত উপকারী ও নিরীহ একটা প্রাণী। জলজ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এর গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। ডলফিনকে বলা হয় উপকূলীয় প্রতিবেশের প্রহরী। এ ছাড়া নদীতে দূষণের পরিমাণ কেমন, তা ডলফিনের অবস্থা ও সংখ্যা দেখে খুব সহজেই অনুমান করা যায়। তাই শিশু-কিশোরদের মনে বিপন্ন ডলফিনের প্রতি মমত্ববোধ তৈরির চেষ্টা থেকেই এই আয়োজন।

ঢাকায় এবার দ্বিতীয়বারের মতো যৌথভাবে এই মেলার আয়োজন করেছে বন বিভাগ ও প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন। বৃহস্পতিবার এই মেলার উদ্বোধন করেন পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার।

শুক্রবার সকালে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে পৌঁছে দেখা যায়, প্রবেশপথের শুরু থেকেই অনেকগুলো ডলফিনের প্রতিকৃতি সাজিয়ে রাখা, যা দেখতে আসল ডলফিনের মতোই। বিষয়টিকে খানিকটা প্রাকৃতিক রূপ দেওয়ার জন্য আশপাশ দিয়ে ছড়িয়ে রাখা হয়েছে মাছ ধরার জাল আর সুন্দরবনের আসল গোলপাতা। জাদুঘরের ফোয়ারা ও দোতলার উন্মুক্ত জায়গাতেও দেখা গেল শৈল্পিকভাবে ফেলে রাখা আরও কিছু ডলফিনের ভাস্কর্য। এক জায়গায় মেঝের ওপর লাল শাকের বীজসহ অন্য শস্য ছড়িয়ে তৈরি করা হয়েছে একটি প্রতিকৃতি। আর একটা তৈরির কাজ চলছে। এখানেই আছে ডলফিনবিষয়ক গ্রন্থ ও আলোকচিত্র প্রদর্শনের ব্যবস্থা। সেখানে ঝুলছে গাঙ্গেয় ডলফিন ও ইরাবতী ডলফিনের অপূর্ব সব স্থিরচিত্র, সুন্দরবনের ডলফিনের অভয়ারণ্যে জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য। আর এক পাশে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও শিশুদের উপস্থিতিতে চলছে ডলফিন বাঁচাতে সচেতনতামূলক পুতুলনাচের প্রদর্শনী।

শিশুকে ডলফিন দেখাচ্ছেন এক নারী। আগারগাঁও, ঢাকা। ছবি: আশরাফুল আলম
শিশুকে ডলফিন দেখাচ্ছেন এক নারী। আগারগাঁও, ঢাকা। ছবি: আশরাফুল আলম

পুতুলনাচ প্রদর্শনের সময় শিশুদের কলকাকলি ও হর্ষধ্বনির মধ্যেই আয়োজকদের একজন জানালেন, একটু আগেই সুন্দরবন–সংলগ্ন দাকোপ উপজেলা থেকে আসা মৌয়াল শেখর রায় ও বাওয়ালি (গোলপাতা সংগ্রহকারী) স্তেফান হালদার শিশুদের বনের ভেতর থেকে মধু ও গোলপাতা সংগ্রহের অভিজ্ঞতার গল্প শুনিয়েছেন। একই সময়ে আরেক পাশে বায়োস্কোপ নিয়ে বসে ছিলেন খুলনার বাসিন্দা আবদুল হালিম সরদার। বায়োস্কোপে চোখ লাগানো শিশুদের কাছে তখন তিনি সংশ্লিষ্ট ছবির সঙ্গে সংগতি রেখে সুরে সুরে বর্ণনা করছিলেন শ্বাপৎসংকুল সুন্দরবনের চমৎকার সব গল্পগাথা।

বায়োস্কোপ দেখায় ব্যস্ত শিশুরা। আগারগাঁও, ঢাকা। ছবি: আশরাফুল আলম
বায়োস্কোপ দেখায় ব্যস্ত শিশুরা। আগারগাঁও, ঢাকা। ছবি: আশরাফুল আলম

আয়োজকেরা বলছেন, বিশ্বে প্রায় ৪৩ প্রজাতির ডলফিন রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে ৭ প্রজাতির ডলফিনের দেখা মেলে। গাঙ্গেয় ডলফিন বা শুশুক বাংলাদেশের মিঠা পানির নদীর প্রধানতম ডলফিন প্রজাতি। সুন্দরবনের নদীতে গাঙ্গেয় শুশুক এবং ইরাবতী ডলফিন দেখা যায়। এই দুই প্রজাতির ডলফিনই বর্তমানে সারা বিশ্বে বিপন্ন অবস্থায় আছে।

সাধারণত গাঙ্গেয় শুশুক বেশি দেখা যায় দুটি নদীর মিলনস্থল, নদীর বাঁক ও গভীর অংশে। এরা দেখতে ধূসর-বাদামি রঙের। এদের প্রধান খাদ্য মাছ। অন্যদিকে ইরাবতী ডলফিন বেশি দেখা যায় নোনা পানি ও নদীর মোহনায়। দেখতে সাধারণত ধূসর বা নীলচে ধূসর ও পেটের দিকে ফিকে বর্ণের হয়। মাছ, সামুদ্রিক স্কুইড, অক্টোপাস ও চিংড়ি ইরাবতী ডলফিনের প্রধান খাদ্য।

কাগজ দিয়ে ডলফিন বানাচ্ছে খুদে শিক্ষার্থীরা। আগারগাঁও, ঢাকা। ছবি: আশরাফুল আলম
কাগজ দিয়ে ডলফিন বানাচ্ছে খুদে শিক্ষার্থীরা। আগারগাঁও, ঢাকা। ছবি: আশরাফুল আলম

কথা হয় আইইউসিএন, বাংলাদেশের সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার ও বন্য প্রাণী গবেষক এ বি এম সারোয়ার আলমের সঙ্গে। ঢাকায় এমন একটা মেলা আয়োজনের যৌক্তিকতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এই আয়োজনে মূলত শিশু-কিশোর ও তরুণদের প্রাধান্য দিয়েছি। তিন দিনের এই মেলায় ঢাকা এবং আশপাশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত শ শিক্ষার্থী নানা কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছে। এভাবে এই প্রজন্মের ভেতর যদি ডলফিনের প্রতি ভালোবাসা জন্মায়, তাহলে ডলফিনের অস্তিত্ব রক্ষার দায়িত্ব হয়তো তারাই নিয়ে নেবে।’

সারোয়ার আলম বলেন, একই উদ্দেশ্যে আগামী ৩০ নভেম্বর থেকে খুলনা ও সাতক্ষীরার বিভিন্ন পয়েন্টে ১০ দিনব্যাপী শুশুক মেলার আয়োজন করা হয়েছে।

মেলা চলবে শনিবার দুপুর পর্যন্ত। অন্য সবকিছুর সঙ্গে থাকবে চারু ও কালুশিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন এবং বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে মতবিনিময় পর্ব।