পানছড়ির পান বরজের গ্রাম

পানের বরজে কাজ করছেন এক চাষি। সম্প্রতি খাগড়াছড়ির বড় পানছড়ি এলাকায়।  প্রথম আলো
পানের বরজে কাজ করছেন এক চাষি। সম্প্রতি খাগড়াছড়ির বড় পানছড়ি এলাকায়। প্রথম আলো

খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি গ্রাম বড় পানছড়িতে ঢুকতেই চোখে পড়ে সারি সারি পানের বরজ। গ্রামের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে কেবল পান আর পান। কমপক্ষে দুই শ পানের বরজ রয়েছে সেখানে। গ্রামের ২৩১ পরিবারের সবাই কোনো না–কোনোভাবে পান চাষের সঙ্গে যুক্ত। পান চাষের আয় দিয়েই চলে তাদের সংসার।

পানছড়ি সদর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে দুর্গম পাহাড়ি গ্রাম বড় পানছড়ি। গ্রামের মধ্যদিয়ে বয়ে গেছে বড় পানছড়ি নামের একটা ছোট আকারের পাহাড়ি ছড়া। এই ছড়ার নামেই গ্রামের নাম। ছড়ার দুই পাশে ছোট ছোট পাহাড়ের ওপর গ্রামের বাসিন্দাদের বসতঘর। আর নিচে ছড়ার দুই পাড়ে শণ ও বাঁশের ঘেরা দেওয়া সারি সারি পানের বরজ।

সম্প্রতি বড় পানছড়ি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের বাসিন্দাদের কেউ পান বরজের পরিচর্যা করছেন। কেউ বা বরজ থেকে পান সংগ্রহ করে বাড়ির উঠানে এনে জড়ো করে রাখছেন। সেখানে পরিবারের সদস্যরা পান বাছাই করে আলাদা করে রাখছেন।

পানছড়ি উপজেলা কৃষি বিভাগ থেকে জানা যায়, ২০১৭ সালের জরিপ অনুযায়ী পানছড়ি উপজেলায় পাঁচটি ইউনিয়নে ৪৩৩টি পান বরজ রয়েছে। তার মধ্যে বেশির ভাগ বরজই গড়ে উঠেছে বড় পানছড়ি গ্রামে।

কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা আরও জানিয়েছেন, ২০১৭ সালে পানছড়ি উপজেলায় পান চাষ হয়েছিল ২৫ হেক্টর জমিতে। আর উৎপাদন হয় ৭৫ মেট্রিকটন পান। গত দুই বছরে পান বরজের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। বেড়েছে পানের উৎপাদনও। তবে কৃষি বিভাগের কাছে পানের উৎপাদনের হালনাগাদ তথ্য নেই।

স্থানীয়েরা বললেন, যুগ যুগ ধরে এই এলাকায় পানের চাষ হচ্ছে। পানের জন্য বিখ্যাত ছিল এই গ্রাম। এখানকার পান সুস্বাদু হওয়ায় সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এর চাহিদা রয়েছে।

পানচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি সপ্তাহে শনিবার, সোমবার ও বুধবার পানবরজ থেকে পান তোলা হয়। স্থানীয় হাটবাজার ছাড়াও রাঙামাটি, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, মাটিরাঙ্গা, ফেনী, রামগড়সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে ব্যবসায়ীরা গ্রামে এসে পান নিয়ে যান। বাজারে বর্তমানে বড় পানের এক বিড়া (৮০টি পান) বিক্রি হয় ৯০ থেকে ১৩০ টাকায়। মাঝারি আকারের এক বিড়া ৬০-৮০ টাকায় আর ছোট আকারের বিড়া ৩০-৭০ টাকায় বিক্রি হয়।

 বড় পানছড়ি এলাকার পানচাষি পরিতোষ চাকমা (৫২) বলেন, ‘বাপ-দাদার আমল থেকে দেখে এসেছি পান চাষ করতে। তারই ধারাবাহিকতায় আমরা তিন ভাই পান চাষের সঙ্গে যুক্ত হই। আমাদের উপার্জনের একমাত্র উপায় হচ্ছে পান চাষ। ৪৫ শতক পাহাড়ি জমিতে পান চাষ করেছি। খরচ হয়েছে ৪০ হাজার টাকা। ইতিমধ্যে পান বিক্রি করে পেয়েছি ৮০ হাজার টাকা। আগামী কয়েক মাসে আরও লাখ টাকার পান বিক্রি করতে পারব।’

পানচাষি অনুজয় চাকমা বলেন, ১৭ বছর ধরে ৪০ শতক জমিতে পান চাষ করছেন তিনি। এর মাধ্যমেই সংসারের খরচ জোগাচ্ছেন তিনি। এক সন্তানকে কলেজে আর এক সন্তানকে স্কুলে পড়াচ্ছেন। পরিবারের সবাই মিলে পান বরজে কাজ করেন তাঁরা। তাই খরচ নেই বললেই চলে। প্রতি সপ্তাহে তিনি ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার পান বিক্রি করেন। পান এখন আর হাটে নিয়ে যেতে হয় না। ব্যবসায়ীরা বাড়ি এসে ন্যায্য দাম দিয়ে কিনে নিয়ে যান।

পান ব্যবসায়ী যতীন্দ্র চাকমা বলেন, প্রতি সপ্তাহে ৭ থেকে ৮টি গাড়ি ভর্তি পান যায় বড় পানছড়ি গ্রাম থেকে। হাটের দিন প্রায় ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকার বেচাকেনা হয়। পান চাষে যেমন লাভ রয়েছে তেমনি অন্য ফসলের তুলনায় পরিশ্রমও করতে হয় বেশি। তবে একবার রোগ আক্রান্ত হলে সব শেষ হয়ে যায়। ঋণ সুবিধা দিলে কৃষকেরা আরও উপকৃত হতেন।

লোগাং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রত্যুত্তর চাকমা বলেন, পানছড়ির পানের চাহিদা রয়েছে প্রচুর। তবে অন্যান্য ফসলের মতো কৃষি বিভাগ থেকে যদি প্রণোদনা ও সহজ কিস্তিতে ঋণ দেওয়া হয় তাহলে পান চাষ আরও বাড়বে।

পানছড়ি কৃষি কর্মকর্তা আলাউদ্দিন শেখ বলেন, ‘বড় পানছড়ি এলাকার পান চাষ বাড়ছে। আমি নিজে  বরজগুলো দেখে এসেছি। সেখানকার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাকে পানচাষিদের সহযোগিতা করার জন্য বলা হয়েছে। তাঁদের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করা যায় কিনা সে ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করব।’