আপত্তির মুখেও বিদেশ থেকে আসছে গরুর মাংস

গরুর মাংস
গরুর মাংস

গরুর মাংসে উদ্বৃত্ত দেশ হওয়া সত্ত্বেও দেশে হিমায়িত গরু ও মহিষের মাংস আমদানি করা হচ্ছে। ভারত, সৌদি আরব ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে গত ছয় মাসে ২০ লাখ ৪৩ হাজার কেজি হাড্ডিবিহীন মাংস আমদানি হয়েছে। এখন ব্রাজিল থেকে আরও বেশি পরিমাণে হিমায়িত গরুর মাংস আমদানির প্রস্তাব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বিবেচনাধীন রয়েছে।

তৈরি পোশাক রপ্তানির বিনিময়ে হিমায়িত গরুর মাংস আমদানির জন্য বাংলাদেশের কাছে সম্প্রতি প্রস্তাব দিয়েছে ব্রাজিল সরকার। প্রস্তাবটি বিবেচনায় নেওয়া যায় কি না, সে সম্পর্কে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি ধারণাপত্র জমা দিয়েছে তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)। তবে মাংস আমদানির বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আপত্তি রয়েছে। কারণ, আমদানি করা মাংসে কোনো ধরনের রোগজীবাণু আছে কি না, সেটা পরীক্ষা করার মতো ল্যাবরেটরি দেশে নেই। এর মধ্য দিয়ে নানা রোগবালাই দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

এ খাতসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, গরু-ছাগল কতটা বেড়েছে, তা নিয়ে সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে বিতর্ক থাকতে পারে। তবে বাংলাদেশ যে এই দুটি গবাদিপশুর উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ, তাতে কোনো সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার দ্বিমত নেই। গত ১৪ জুন জাতীয় সংসদে বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দেন, ‘দেশ গরু-ছাগলে স্বয়ংসম্পূর্ণ।’ কেবল তা-ই নয়, ‘দেশ গরু-ছাগলের মাংসে উদ্বৃত্ত’ এই তথ্য উল্লেখ করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে এ দুটি প্রাণীর মাংস রপ্তানির উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। এই অবস্থার মধ্যেই শুরু হয়েছে মাংস আমদানি।

>৬ মাসে ভারতসহ ৩ দেশ থেকে এসেছে ২০ লাখ কেজি।
এখন ব্রাজিল থেকে মাংস আমদানির প্রস্তাব বিবেচনায়।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ গরু-ছাগল এখন উদ্বৃত্ত। আমরা বিদেশে মাংস রপ্তানির প্রস্তুতি নিচ্ছি। সেখানে আমদানির প্রশ্নই আসে না।’ তিনি জানান, মাংস আমদানি যাতে না হয়, সেই ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ছাড়াও প্রাণিসম্পদের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত সংস্থাগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ অ্যানিমেল হেলথ কোম্পানি অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে মাংস আমদানি বন্ধ করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। একই দাবি করেছে মাংস ব্যবসায়ী সমিতিও।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে অর্থায়নকারী সরকারি সংস্থা পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) থেকে দেশের গবাদিপশু খাতে প্রায় তিন হাজার কোটি টানা লগ্নি করা হয়েছে। স্থানীয় ছোট উদ্যোক্তা ও কৃষকদের মধ্যে দেওয়া ওই ঋণও হুমকিতে পড়তে পারে বলে সংস্থাটি মনে করছে। কারণ, বিদেশি গরুর মাংস আমদানি হলে দেশীয় উদ্যোক্তারা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন। বিনিয়োগ করা অর্থ ফিরিয়ে আনা তখন কঠিন হয়ে যাবে।

তবে বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক প্রথম আলোকে বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে মাংস আমদানি ও তৈরি পোশাক রপ্তানির বিষয়ে তাঁরা একটি প্রস্তাব দিয়েছেন। ব্রাজিল থেকে মাংস আনলে বাংলাদেশ আগের চেয়ে অনেক বেশি তৈরি পোশাক রপ্তানির সুযোগ পাবে। মাংস আমদানির ক্ষেত্রে অন্য কোনো বিষয় বিবেচনায় থাকলে তা দেখার দায়িত্ব সরকারের।

এদিকে গত ১২ সেপ্টেম্বর বাণিজ্যসচিবের কাছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব অমিতাভ চক্রবর্তীর দেওয়া এক চিঠিতে বলা হয়, ‘যৌক্তিক কারণে দেশের স্বার্থে ব্রাজিল থেকে গরুর মাংস আমদানির প্রক্রিয়াটি বন্ধে বাংলাদেশ অ্যানিমেল হেলথ কোম্পানি অ্যাসোসিয়েশন থেকে যে দাবি জানানো হয়েছে, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।’ ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, দেশের জনসংখ্যার ২০ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ এবং ৪৫ শতাংশ মানুষ পরোক্ষভাবে গবাদিপশু লালনপালনের ওপর নির্ভরশীল। কয়েক বছর ধরে বিদেশ থেকে গরু আমদানি ছাড়াই কোরবানির চাহিদা মেটানো হচ্ছে। গত সাত বছরে প্রায় পাঁচ লাখ পরিবার গরু-ছাগল লালনপালনে যুক্ত হয়েছে। যাঁদের বেশির ভাগই শিক্ষিত তরুণ। এ ছাড়া ব্রাজিলের মাংস নিরাপদ নয় বলে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ওই মাংস তাদের দেশে আমদানি নিষিদ্ধ করেছে।

এ বিষয়ে গতকাল সোমবার কথা হয় বাণিজ্যসচিব মো. জাফর উদ্দীনের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তৈরি পোশাকের বিনিময়ে ব্রাজিল গরুর মাংস রপ্তানির যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখছি। এতে দুই দেশেরই লাভ হবে।’ তিনি বলেন, ‘গরুর মাংস শুধু খাবার হিসেবে আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়, এর সঙ্গে দেশের কয়েক কোটি মানুষের জীবিকা জড়িত। এই খাতের উদ্যোক্তারা আমার সঙ্গে দেখা করে আমদানি বন্ধের অনুরোধ করেছেন। সামগ্রিকভাবে দেশের জন্য ভালো হয় এমন সিদ্ধান্তই আমরা নেব।’

এর আগে মাংস আমদানির বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মতামত চেয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৮ এপ্রিল অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হীরেশ রঞ্জন ভৌমিক লিখিতভাবে ভারত থেকে জীবিত গরু ও মহিষের হিমায়িত মাংস আমদানির ব্যাপারে আপত্তি দেন।

তখন এ নিয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ-সংক্রান্ত দাপ্তরিক চিঠি থেকে জানা যায়, ওই বৈঠকে অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, হিমায়িত মাংসে কোনো ধরনের রোগজীবাণু আছে কি না, তা পরীক্ষা করার মতো ল্যাবরেটরি দেশে নেই। আমদানি করা গরু-মহিষের সঙ্গে আন্তসীমান্ত রোগ ও জিনগত রোগবালাই বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। কূটনীতিকদের জন্য সীমিত আকারে এ ধরনের মাংস আমদানি করা যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বিধিমালা অনুসরণ করতে হবে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অনাপত্তিপত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। আর আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে দেশে গরুর উৎপাদন বাড়াতে হবে। এ ছাড়া ওই বৈঠকে জীবন্ত গরু-মহিষ ও হিমায়িত মাংস আমদানির ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ করে আমদানি নিরুৎসাহিত করার সুপারিশ করা হয়।

এ ব্যাপারে পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, গবাদিপশু উৎপাদনের এই খাত দেশের দারিদ্র্যবিমোচন ও পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত তরুণের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে। এখন বিদেশ থেকে মাংস আমদানি করলে পুরো খাতটি বিপদে পড়বে। মাংস আমদানির ওই প্রস্তাবকে কোনোভাবেই সমর্থন করা যাচ্ছে না। সরকারের উচিত হবে এই খাতের জন্য ক্ষতি হয় এমন কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়া।