বিএফআইইউতে ৪ শতাধিক ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়েছে দুদক

দুদক
দুদক

চলমান ‘শুদ্ধি অভিযান’ শুরুর পর জব্দ করা চার শতাধিক ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। চার শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব বিবরণী ও প্রকৃত আর্থিক লেনদেনের তথ্য জরুরি ভিত্তিতে দুদকে পাঠানোর অনুরোধ করা হয়েছে।

দুদক সূত্র প্রথম আলোকে চিঠি পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। সূত্র জানায়, সংস্থার বিশেষ তদন্ত বিভাগের মহাপরিচালক সাইদ মাহবুব খান স্বাক্ষরিত চিঠি আজ বুধবার বিএফআইইউর মহাব্যবস্থাপক বরাবর পাঠানো হয়েছে।

চিঠিতে বলা হয়, চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে দুদকে বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনসংক্রান্ত অনুসন্ধান ও মামলা চলমান আছে। বিভিন্ন সূত্র দুদক জেনেছে, অভিযান শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত চার শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্তের স্বার্থে জব্দ হওয়া হিসাবগুলোর বিবরণী ও লেনদেনসংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা জরুরি।

তাই দুদকের পক্ষ থেকে জরুরি ভিত্তিতে ওই সব তথ্য জরুরিভাবে পাঠানোর অনুরোধ জানানো হয়েছে।

এর আগে গত সোমবার শতাধিক ব্যক্তির সম্পদ ও ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়ে এনবিআর ও বিএফআইইউতে চিঠি পাঠায় দুদক । এই ১০০ জনের মধ্যে সরকার-দলীয় চার সাংসদসহ অধিকাংশই রাজনীতিক। ইতিমধ্যে এনবিআর তাঁদের সম্পদ ও ব্যাংক হিসাব তলব করেছে।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর ‘শুদ্ধি’ অভিযান শুরুর পর দুদক প্রথমে ৪৩ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরুর কথা জানালেও এই তালিকা দিন দিন বড় হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৩৪ জনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার প্রক্রিয়াও শুরু করেছে দুদক।

গত মাসে অভিযান শুরুর প্রথম দিনই রাজধানীর ইয়ংমেনস ফকিরাপুল ক্লাব থেকে গ্রেপ্তার হন ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক (পরে বহিষ্কৃত) খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। এরপর বিভিন্ন অভিযানে একে একে গ্রেপ্তার হন কথিত যুবলীগ নেতা ও ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীম, মোহামেডান ক্লাবের ডাইরেক্টর ইনচার্জ লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি (বহিষ্কৃত) ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট, তাঁর সহযোগী এনামুল হক ওরফে আরমান, কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের সভাপতি শফিকুল আলম ওরফে ফিরোজ, অনলাইন ক্যাসিনোর হোতা সেলিম প্রধান এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান ও তারেকুজ্জামান রাজীব।

অবৈধভাবে বিপুল অর্থের মালিক হওয়া, অর্থ পাচারসহ নানা অভিযোগ ওঠে এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে। জিজ্ঞাসাবাদে তাঁদের অপকর্মে সহযোগী ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সাংসদ, রাজনীতিক, সরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্নজনের নাম বেরিয়ে আসে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তের পাশাপাশি অবৈধ সম্পদের খোঁজে মাঠে নামে দুদকও। গত ৩০ সেপ্টেম্বর বিতর্কিত ব্যক্তিদের সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। এ জন্য পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের অনুসন্ধান দল গঠন করে দুদক। পরে আরও দুজনকে দলে যুক্ত করা হয়।

দুদকের অনুসন্ধান তালিকায় একে একে যুক্ত হয় ভোলার সাংসদ নুরুন্নবী চৌধুরী ওরফে শাওন, চট্টগ্রামের সাংসদ ও হুইপ সামশুল হক চৌধুরী এবং সুনামগঞ্জ-১ আসনের সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেনের নাম। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সাংসদ নজরুল ইসলাম ওরফে বাবুর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু না করলেও তাঁর সম্পদ ও ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়েছে দুদক।

সম্পদ ও ব্যাংক হিসাব তলব
আরও যাঁদের সম্পদ ও ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে তাঁরা হলেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা আবু কাওছার, তাঁর স্ত্রী পারভীন লুনা, মেয়ে নুজহাত নাদিয়া নীলা এবং তাঁদের প্রতিষ্ঠান ফাইন পাওয়ার সল্যুশন লিমিটেড; যুবলীগের সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী, তাঁর স্ত্রী শেখ সুলতানা রেখা, ছেলে আবিদ চৌধুরী, মুক্তাদির আহমেদ চৌধুরী ও ইশতিয়াক আহমেদ চৌধুরী এবং তাঁদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান লেক ভিউ প্রোপার্টিজ ও রাও কনস্ট্রাকশন; যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুর রহমান মারুফ, তাঁর স্ত্রী সানজিদা রহমান, তাঁদের দুটি প্রতিষ্ঠান টি-টোয়েন্টি ফোর গেমিং কোম্পানি লিমিটেড ও টি-টোয়েন্টি ফোর ল ফার্ম লিমিটেডের ব্যাংক হিসাব; স্বেচ্ছাসেবক লীগের অর্থ সম্পাদক কে এম মাসুদুর রহমান, তাঁর স্ত্রী লুতফুর নাহার লুনা, বাবা আবুল খায়ের খান, মা রাজিয়া খান এবং তাঁদের প্রতিষ্ঠান সেবা গ্রিন লাইন লিমিটেড; যুবলীগ নেতা মুরসালিক আহমেদ, তাঁর বাবা আবদুল লতিফ, মা আছিয়া বেগম, মুরসালিকের স্ত্রী কাওসারী আজাদ প্রমুখ।

সরকারি কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা
গণপূর্ত অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম ও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুল হাইয়ের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জি কে শামীমের সঙ্গে যোগসাজশের। তাঁদের ঘুষ দিয়ে শামীম গণপূর্তের বড় কাজগুলো বাগিয়ে নিয়েছেন। এ কাজে অন্তত আরও ১২ জনের সংশ্লিষ্টতার তথ্য দুদক পেয়েছে। সাবেক প্রধান প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান মুন্সী, বর্তমান অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী উৎপল কুমার দে, নির্বাহী প্রকৌশলী ফজলুল হক, শওকত উল্লাহ, প্রকৌশলী স্বপন চাকমা, রোকন উদ্দিন, আবদুল কাদের চৌধুরী, আফসার উদ্দিন, আবদুল মোমেন চৌধুরী, ইলিয়াস আহমেদ এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী প্রধান মুমিতুর রহমান এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাজ্জাদুল ইসলামের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে দুদক।

তাঁদের মধ্যে রফিকুল ইসলাম ও হাফিজুর রহমান মুন্সীর হিসাব তলব করেছে এনবিআর। হাফিজুরের স্ত্রী মারুফা রহমান কান্তা ও রফিকুলের স্ত্রী রাশেদা ইসলামের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে এনবিআর। সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুল হাই ও তাঁর স্ত্রী বনানী সুলতানার ব্যাংক হিসাবও তলব করেছে এনবিআর।

৯ মামলা
দুদকের অনুসন্ধান দলের সদস্যরা গণমাধ্যমে আসা বিভিন্ন ব্যক্তির নাম যাচাই-বাছাই করে একটি প্রাথমিক তালিকা তৈরি করে। সংস্থার গোয়েন্দা শাখার পক্ষ থেকে এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হয়। পাশাপাশি র‍্যাব ও বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধানেরা দুদক চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করেন।

সেসব তথ্য ও কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে ইতিমধ্যে ৯টি মামলা করে দুদক দল। জি কে শামীম, খালিদ মাহমুদ ভূঁইয়া, গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনামুল হক এনু ও তাঁর ভাই গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক রূপণ ভূঁইয়া, অনলাইন ক্যাসিনোর হোতা সেলিম প্রধান, বিসিবি পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক আনিসুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী সুমি রহমান এবং কলাবাগান ক্লাবের সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজের বিরুদ্ধে ৯টি আলাদা মামলা হয়।

বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা
চলমান ‘শুদ্ধি অভিযান’ শুরু হওয়ার পর দুদক অবৈধ সম্পদের যে অনুসন্ধান শুরু করেছে, তার অংশ হিসেবে শুরুতে তিন সাংসদসহ ২৩ জনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয় সংস্থাটি। আজ বুধবার আরও ১১ জনের বিদেশযাত্রা রহিত করতে চিঠি দেওয়া হয়।
শুরুতে ভোলা ৩ আসনের সাংসদ নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, চট্টগ্রামের সাংসদ ও জাতীয় সংসদের হুইপ শামসুল হক চৌধুরী এবং সুনামগঞ্জ-১ আসনের সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
গ্রেপ্তার হওয়াদের মধ্যে কথিত যুবলীগ নেতা এস এম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীম, মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, মোহামেডান ক্লাবের ডাইরেক্টর ইনচার্জ মো. লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, সম্রাটের সহযোগী এনামুল হক আরমান, কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের সভাপতি মোহাম্মদ শফিকুল আলম (ফিরোজ), অনলাইন ক্যাসিনোর হোতা সেলিম প্রধান এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমানের (মিজান) বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।

নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনামুল হক এনু ও তাঁর ভাই গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক রূপণ ভূঁইয়া, কেন্দ্রীয় যুবলীগের বহিষ্কৃত দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিছুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী সুমি রহমান, লোকমান হোসেন ভূঁইয়ার স্ত্রী নাবিলা লোকমান, গণপূর্ত অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আবদুল হাই , ওয়ার্ড কাউন্সিলর এ কে এম মমিনুল হক সাঈদ এবং এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদারের বিদেশযাত্রায়।
এ ছাড়া এনামুল হকের সহযোগী ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের কর্মচারী আবুল কালাম আজাদ (আজাদ রহমান), রাজধানীর কাকরাইলের জাকির এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. জাকির হোসেন ও সেগুনবাগিচার শফিক এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. শফিকুল ইসলামের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।

আজ বুধবার নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় গণপূর্তের ৯ প্রকৌশলীসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে। তাঁরা হলেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী উৎপল কুমার দে; ছয় নির্বাহী প্রকৌশলী স্বপন চাকমা, মোহাম্মদ শওকত উল্লাহ, মোহাম্মদ ফজলুল হক, আবদুর কাদের চৌধুরী, মো. আফসার উদ্দিন ও মো. ইলিয়াস আহমেদ; তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবদুল মোমেন চৌধুরী ও মো. রোকন উদ্দিন; পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী প্রধান মুমিতুর রহমান ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা সাজ্জাদুল ইসলাম।