অসহায়ের সহায় তাঁরা ৩০ জন

সেবা ফাউন্ডেশন নামের সংগঠনের মাধ্যমে অসহায়দের সেবা দিচ্ছে সিলেটের একদল তরুণ শিক্ষার্থী। চলছে তাঁদের সাংগঠনিক সভা। গতকাল সকালে পূর্ব জাফলংয়ে।  ছবি: প্রথম আলো
সেবা ফাউন্ডেশন নামের সংগঠনের মাধ্যমে অসহায়দের সেবা দিচ্ছে সিলেটের একদল তরুণ শিক্ষার্থী। চলছে তাঁদের সাংগঠনিক সভা। গতকাল সকালে পূর্ব জাফলংয়ে। ছবি: প্রথম আলো

গ্রামের বাজারে আড্ডা দিচ্ছিলেন আট তরুণ। একজন হঠাৎ প্রসঙ্গটা তোলেন। অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে কিছু করা যায়। ওই আড্ডাতেই ঠিক হলো একটা সেবামূলক সংগঠন চালুর। নাম দেওয়া হলো ‘সেবা ফাউন্ডেশন’। 

সেই শুরু। দিনে দিনে সংগঠনের সদস্য বেড়ে হয়েছে ৩০। কেউ শিক্ষার্থী, কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কেউবা চাকরিজীবী। এই স্বেচ্ছাসেবীরা প্রায় প্রতিদিনই কার্যক্রম চালান। কোথাও অসহায় মানুষের খোঁজ পেলেই ছুটে যান। কার কী সমস্যা জেনে নিয়ে উপযুক্ত সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন।

সিলেটের গোয়াইনঘাটে এই সেবা ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু ২০১৭ সালে। প্রথমে শুধু জাফলং ইউনিয়নে কার্যক্রম ছিল। এখন তা পুরো উপজেলায়। চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত এই সংগঠনের মাধ্যমে ৭৪৬ জন অসহায় মানুষ উপকৃত হয়েছেন। দেওয়া হয়েছে বিশেষায়িত চিকিৎসা, পড়াশোনার বৃত্তি, শীতবস্ত্র, উৎসব-পার্বণের সহায়তা, অসচ্ছল পরিবারের মেয়ের বিয়ের জন্য আর্থিক সহায়তা। 

জাফলং হাজী সোহরাব আলী উচ্চবিদ্যালয়ে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী শাহিন আহমেদ (১৫)। ২০১৮ সালের শেষ দিকে বাইসাইকেল চালানোর সময় দুর্ঘটনায় আহত হয়। এরপর পায়ুপথে সংক্রমণ দেখা দেয়। স্কুলে যাওয়াও বন্ধ। শাহিনের বাবা বিল্লাল মিয়া আলীরগাঁও ইউনিয়নের সীমারবাজার গ্রামের দিনমজুর। দুই দফা ছেলেকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। অস্ত্রোপচারসহ অন্যান্য চিকিৎসার খরচ জোগাতেই কাছে থাকা সব টাকা শেষ। অসহায় হয়ে ছেলেকে বাড়িতে ফেরত আনেন বিল্লাল। খবর পেয়ে সেবা ফাউন্ডেশনের সদস্যরা ছুটে যান। শাহিনের চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় শাহিনকে। দুই দফা অস্ত্রোপচারের পর গত জানুয়ারিতে সুস্থ হয় শাহিন। সে এখন নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছে।

শাহিনের বাবা বিল্লাল মিয়া বলেন, ‘আমি সেবা ফাউন্ডেশনের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। সংগঠনটি যেন মানুষের কল্যাণে কাজ করে যেতে পারে, এটিই আমার চাওয়া।’  

একই উপজেলার মুহাম্মদপুর গ্রামের অংকজ বাবু (৫৫)। ফেরি করে আইসক্রিম বিক্রি করে সংসার চালাতেন। গত ফেব্রুয়ারিতে তাঁর রক্তে সংক্রমণ দেখা দেয়। কাজে বের হওয়া বন্ধ হয়ে যায়। অর্থসংকটে চিকিৎসা করাতে পারেননি অংকজ। সারাক্ষণ ঘরেই বসে থাকছিলেন। তাঁরও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে সেবা ফাউন্ডেশন। 

শুধু চিকিৎসা সহায়তা নয়, সেবা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে করা হয় অসহায়–অসচ্ছল পরিবারের মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থাও। এমনই একটি পরিবার জাফলংয়ের লাখের পাড় এলাকার। সেখানকার এক দম্পতি তাঁদের মেয়েকে টাকার অভাবে বিয়ে দিতে পারছিলেন না। চলতি বছরের জুনে বিষয়টি জানতে পারে সেবা ফাউন্ডেশন। তাদের সহায়তায় জমকালো আয়োজনে বিয়ে হয় মেয়েটির। আর্থিক সহযোগিতার পাশাপাশি আত্মীয়স্বজনদের বিয়ের দাওয়াত, বিয়ের আসবাব, অতিথিদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা—সবই করেন সংগঠনটির সদস্যরা।

গতকাল বুধবার সকালে জাফলংয়ের আমির মিয়া উচ্চবিদ্যালয় মাঠে এক সভায় মিলিত হন সেবা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী সদস্যরা। এ সময় সাংগঠনিক কার্যক্রমের পাশাপাশি নতুন কোনো অসহায় মানুষের তথ্য কারও কাছে এসেছে কি না এ নিয়ে আলোচনা হয়। এ সময় কথা হয় সংগঠনের নির্বাহী তিন সদস্য এবং আশপাশের কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে। 

নির্বাহী সদস্য আরিফুজ্জামান আবির বলেন, ‘আমরা ফেসবুকে একটি গ্রুপের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখি। নতুন কারও সহযোগিতার প্রয়োজন হলে এই গ্রুপে জানানো হয়। পাশাপাশি মাসে দুই-তিনবার সদস্যরা বৈঠকে মিলিত হন। এতে চলমান কার্যক্রম এবং ভবিষ্যতে করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয়।’ 

সংগঠন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে আটজন সদস্য নিয়ে যাত্রা শুরু। বর্তমানে এই সংগঠনে ৩০ জন নির্বাহী সদস্য রয়েছেন। তাঁরা প্রত্যেকে মাসে ৫০০ টাকা করে চাঁদা দেন। এ ছাড়া ফেসবুক গ্রুপসহ নানা মাধ্যমে তাঁদের কার্যক্রমের কথা প্রচার হয়েছে। অনেকেই এখন সংগঠনে অনুদান দেন। অনুদানের বড় একটা অংশ আসে প্রবাসে থাকা এই উপজেলার বাসিন্দাদের কাছ থেকে। সদস্য চাঁদা, অনুদান—সবই ব্যাংক হিসাবে জমা থাকে। পরে প্রয়োজন অনুসারে খরচ করা হয়।

আরেক নির্বাহী সদস্য নাদিম মাহমুদ জানান, তাঁদের ‘সেবা সাহিত্য সংসদ’ নামের একটি পাঠাগারও রয়েছে। এ জন্য নির্দিষ্ট জায়গা নেই। তাই সংগঠনের তিনজন নির্বাহী সদস্যের ঘরে আপাতত পাঠাগারের কার্যক্রম চলে। পাঠাগারের সদস্য হতে পারেন জাফলং ইউনিয়নের বাসিন্দারা। তাঁরা এখান থেকে বই নিয়ে নির্দিষ্ট সময় পর ফেরত দেন। এরপর নতুন আরেকটি বই সংগ্রহ করতে পারেন।

উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আবু কাওছার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের রোগী কল্যাণ সমিতি অসহায় মানুষকে চিকিৎসা সহায়তা দিয়ে থাকে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। এ অবস্থায় সেবা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তারা অসহায় রোগীদের খুঁজে চিকিৎসা সহায়তা দিচ্ছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বিশ্বজিৎ কুমার পাল বলেন, ‘আমি নিজেও দুজন রোগীর চিকিৎসার জন্য সেবা ফাউন্ডেশনকে সহায়তা করেছি। উপজেলা প্রশাসন থেকে সহযোগিতা করা হচ্ছে। এমন কাজে অন্যরাও এগিয়ে এলে সমাজের অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’