কেপিএম 'দিনে দিনে শুধু বাড়িয়াছে দেনা'

দেশে সর্বপ্রথম কাগজ তৈরির কারখানা কর্ণফুলী পেপার মিলের অবস্থা এখন জরাজীর্ণ। তারপরও এর মধ্যেই এখনো কিছু কাগজ উৎপাদন হয় এখানে। কাগজ তৈরির কাজে ব্যস্ত শ্রমিকদের ছবিটি সম্প্রতি তোলা।  সৌরভ দাশ
দেশে সর্বপ্রথম কাগজ তৈরির কারখানা কর্ণফুলী পেপার মিলের অবস্থা এখন জরাজীর্ণ। তারপরও এর মধ্যেই এখনো কিছু কাগজ উৎপাদন হয় এখানে। কাগজ তৈরির কাজে ব্যস্ত শ্রমিকদের ছবিটি সম্প্রতি তোলা। সৌরভ দাশ

রাষ্ট্রায়ত্ত কাগজকল কর্ণফুলী পেপার মিলের (কেপিএম) মণ্ড তৈরির কারখানা সেকশনটি প্রায় তিন বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। দুই বছর ধরে বিকল কাগজ উৎপাদনে ব্যবহৃত ২ নম্বর মেশিনটি। এর ওপর শ্রমিক ও ঠিকাদারের পাওনা, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা সংকটে থাকা কাগজকলটির অবস্থা তারাপদ রায়ের ‘দারিদ্র্যরেখা’ কবিতার মতো। ‘অপরিসীম দারিদ্র্যের মধ্যে আমার কষ্টের দিন, দিনের পর দিন আর শেষ হয় না। আমি আরও জীর্ণ আরও ক্লিষ্ট হয়ে গেলাম।’ এই অবস্থায় দিনে ৫ থেকে ২৫ টন কাগজ উৎপাদন করে কোনোরকমে জানান দিচ্ছে ‘প্রাণ আছে, এখনো প্রাণ আছে।’
রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনা এলাকায় ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রায়ত্ত কাগজকলটির ৫ হাজার শ্রমিকের মধ্যে এখন অবশিষ্ট মাত্র ৭৫০ জন। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) সর্বশেষ লাভের মুখ দেখেছে ২০০৮ সালে।

বিকল মেশিন, পচছে বাঁশ
সরেজমিনে দেখা যায়, তিন বছর আগে বন্ধ হওয়া মণ্ড কারখানার আশপাশে পড়ে রয়েছে পচা বাঁশের টুকরো। পাল্প কারখানা বন্ধের কারণে ১০ কোটি টাকার এই কাঁচামাল এখন পরিত্যক্ত। আর কারখানাটিতে যেন মরিচার আস্তরণ।
এটি বন্ধ থাকায় বন বিভাগের ১ লাখ ৬২ একর বনভূমি থেকে তিন বছর ধরে বাঁশ সংগ্রহ করছে না কেপিএম। এ বছর কেপিএম চিঠি দিয়ে বাঁশ নিতে অপারগতা প্রকাশ করেছে। ১৯৫৩ সালে কেপিএমের সঙ্গে বন বিভাগের বাঁশ সংগ্রহের এই চুক্তি হয়েছিল।
রাঙামাটি অঞ্চলের বন সংরক্ষক মো. ছানাউল্যা পাটওয়ারী বলেন, সর্বশেষ ২০১৫-১৬ সালে কেপিএম ১৫ লাখ ৯৫ হাজার বাঁশ সংগ্রহ করেছিল। এখন সিদ্ধান্ত হয়েছে বন বিভাগ বাঁশ বাইরে বিক্রি করে দেবে।
বাঁশ সরবরাহকারী ঠিকাদার সমিতির উপদেষ্টা ফরিদ আহম্মদ বলেন, কেপিএম বন্ধ করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র থেকে পাল্প সেকশন বন্ধ করে রাখা হয়।
কেপিএমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এম আবদুল কাদের বলেন, ৭০ বছরের পুরোনো কারখানা। এদিকে মেরামত করলে ওদিকে সমস্যা দেখা দেয়। বন্ধ করার ষড়যন্ত্রের ভিত্তি নেই।
জানা গেছে, ৩০ বছর ধরে কোনো সংস্কার (ওভারহোলিং) না হওয়ায় জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। ১ নম্বর মেশিনে উৎপাদন চলছে। কর্তব্যরত শ্রমিকেরা জানান, এই মেশিনটিও ক্ষণে ক্ষণে বিকল হয়ে যায়।

উৎপাদন কমছে, দেনা বাড়ছে
প্রতিষ্ঠাকালে এই কারখানার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩০ হাজার টন। সর্বশেষ ২০০৮-০৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি ৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা লাভ করেছিল। তখন উৎপাদন ছিল ২৪ হাজার ২০০ টন।
গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩ হাজার ১৮২ টনের বিপরীতে লোকসান হয় ২৭ কোটি ৬১ লাখ টাকা। ১৮-১৯ সালে উৎপাদন হয় সাড়ে ৫ হাজার টন।
কেপিএমের প্রায় ৭০০ কোটি টাকার বেশি দেনার মধ্যে ১০০ কোটি টাকা করে পাবেন শ্রমিক ও ঠিকাদার। বাকি ৫০০ কোটি টাকা ঋণ।
এখন নতুন করে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। আগে কেপিএেমের ঘনমিটার প্রতি গ্যাসে ব্যয় হতো ৯ দশমিক ৬২ টাকা। জুলাই থেকে তা বেড়ে হয়েছে ১৩ দশমিক ৮৫ টাকা। এমডি আবদুল কাদের বলেন, ‘যদি সার কারখানায় যে দামে (৪.৪৫ টাকা) গ্যাস দেওয়া হয় সেভাবে আমাদের ভর্তুকি দিত তাহলে সংকট উত্তরণ করতে পারতাম।’
এই অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) আস্থা হারিয়েছে। এনসিটিবির প্রতিবছর প্রায় ৮০ হাজার টন কাগজ লাগে। গত বছর কেপিএম এনসিটিবি থেকে ১ হাজার টন কাগজের কার্যাদেশ পেয়েছিল। কিন্তু সরবরাহ করতে পারেনি।

শ্রমিকের হাহাকার
শ্রমিকদের বিসিআইসির অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে বদলি করা হয়েছে। বদলি কিংবা অবসরে যাওয়া শ্রমিকেরা নিজেদের পিএফ (ভবিষ্য তহবিল) ও গ্র্যাচুইটির জন্য ধরনা দিচ্ছেন।
শ্রমিক মোহাম্মদ ইসমাইলকে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিইউএফএল সার কারখানায় বদলি করা হয়। কিন্তু গত তিন বছরেও তাঁর পিএফ ও গ্র্যাচুইটির পাওনা টাকা সিইউএফএল কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়নি। এক বছর পর ইসমাইল সিইউএফএল থেকে অবসরে যাবেন। এ রকম প্রায় ৪০০ শ্রমিক কিংবা স্বজন পাওনা টাকার জন্য কেপিএমের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। জানা গেছে, স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে কেপিএমের সংকট উত্তরণের চেষ্টা করছে বিসিআইসি। জানতে চাইলে বিসিআইসির পরিচালক (উৎপাদন) শাহীন কামাল বলেন, কারখানাটি বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিসিআইসি ঋণ দিয়েছে। শ্রমিকদের পাওনা বকেয়া, মালামাল সরবরাহকারীর টাকা বকেয়া। কারখানাটি কার্যকর করার জন্য চীনের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে।