স্বাস্থ্যঝুঁকি সামলাতে প্রস্তুতি দুর্বল

এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ কোন মাত্রায় পৌঁছাবে, তার পূর্বাভাস স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো দপ্তর দিতে পারেনি। জুলাই মাসে ডেঙ্গুর চাপ সামাল দিতে ঢাকার হাসপাতালগুলো যখন হিমশিম খাচ্ছিল, তখনো মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কল্পনা করতে পারেননি যে সারা দেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়বে। এর কারণ, ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে তাঁদের কোনো প্রস্তুতি ছিল না।

এ সপ্তাহে প্রকাশিত একটি বৈশ্বিক প্রতিবেদন স্বাস্থ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রস্তুতির বিষয়গুলো স্পষ্ট করেছে। প্রতিবেদনটি বলছে, জরুরি অবস্থায় কাজে নেমে পড়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রস্তুতি শূন্যের কোঠায়। জনস্বাস্থ্য ও নানা ধরনের নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয়ের অবস্থাও একই। জনস্বাস্থ্য ও জীবজন্তুর রোগের জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে কোনো সমঝোতা নেই। স্বাস্থ্যনিরাপত্তায় বৈশ্বিক গড় মানের (স্কোর ৪২ দশমিক ২) চেয়েও বাংলাদেশের অবস্থা খারাপ। ৩৫ স্কোর নিয়ে ১৯৫টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১১৩। দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে ভারত, মিয়ানমার, ভুটান, পাকিস্তান ও নেপাল। তবে বাংলাদেশের টিকাদান কর্মসূচি ও রোগনির্ণয় ব্যবস্থাকে (ল্যাবরেটরি) ভালো বলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি মানার সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান ভালো।

‘বৈশ্বিক স্বাস্থ্যনিরাপত্তা সূচক: যৌথ উদ্যোগ ও জবাবদিহি নির্মাণ ২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে এসব তথ্য দেওয়া হয়েছে। জীবনের ঝুঁকি কমাতে নিয়োজিত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান নিউক্লিয়ার থ্রেট ইনিশিয়েটিভ, যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর হেলথ সিকিউরিটি এবং ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট যৌথভাবে ৩২৪ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন, ওপেন ফিলানথ্রপি প্রজেক্ট ও রবার্টসন ফাউন্ডেশন। এই তিন মার্কিন প্রতিষ্ঠান চিকিৎসা গবেষণায় অর্থ সহায়তা দেয়।

গবেষকেরা বলেছেন, বৈশ্বিক স্বাস্থ্যনিরাপত্তা সূচক তৈরির এই প্রথম উদ্যোগের মাধ্যমে ১৯৫টি দেশের স্বাস্থ্যনিরাপত্তা এবং এ–সম্পর্কিত সক্ষমতা কী আছে, তার মানদণ্ড ঠিক করা হয়েছে। এই দেশগুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০০৫ সালের আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শতাধিক গবেষক এই প্রতিবেদন তৈরির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

প্রতিবেদনটি বলছে, জাতীয় স্বাস্থ্যনিরাপত্তার বিষয়টি বৈশ্বিকভাবে দুর্বল। কোনো দেশই মহামারি মোকাবিলায় পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। প্রতিটি দেশের কোথাও না কোথাও ঘাটতি আছে।

>

বৈশ্বিক স্বাস্থ্যনিরাপত্তা সূচক
বৈশ্বিক গড় মানের চেয়েও বাংলাদেশের অবস্থা খারাপ
৩৪টি সূচকের মধ্যে ১১টিতে ০ স্কোর

রোগ প্রতিরোধ, রোগ শনাক্তকরণ ও জানানো, ত্বরিত কাজে নামা, স্বাস্থ্যকাঠামো ও পদ্ধতি, আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মানা এবং ঝুঁকির পরিবেশ—এই ছয়টি বিষয়ে মোট ৩৪টি সূচকের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। সব মিলে ১৪০টি প্রশ্নের উত্তর নেওয়া হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, ১০০–এর মধ্যে বৈশ্বিক গড় স্কোর ৪২ দশমিক ২। ৮৩ দশমিক ৫ স্কোর নিয়ে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্র। আর ১৬ দশমিক ২ স্কোর নিয়ে তালিকার সবচেয়ে নিচে মধ্য আফ্রিকার দেশ ইক্যুয়েটরিয়াল গিনি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের প্রতিটি দেশেরই জীবাণুর ঝুঁকি আছে। এই ঝুঁকি প্রাকৃতিক হতে পারে, দুর্ঘটনাজনিত হতে পারে। আবার ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ এই ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। এসব ঝুঁকির সম্ভাব্য পরিণতিতে বহু মৃত্যু হতে পারে, অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে, এমনকি রাজনৈতিক ও সামাজিক হট্টগোল, অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির আশঙ্কাও থাকে। বৈশ্বিক বাণিজ্য, নগরায়ণ, উচ্চ জৈবপ্রযুক্তি, সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ও কোনো রাষ্ট্রের গণবিধ্বংসী অস্ত্রের ব্যবহার এই ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে।

বাংলাদেশ পরিস্থিতি


অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হওয়া একটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সমস্যা। এটি মোকাবিলায় বাংলাদেশের উদ্যোগ-আয়োজন মাঝারি মানের চেয়েও খারাপ। ৩৪টি সূচকের মধ্যে জৈব নিরাপত্তা, জীবাণুঝুঁকিসহ ১১টিতে বাংলাদেশ কোনো নম্বর পায়নি। অর্থাৎ স্কোর শূন্য।

ডেঙ্গুর প্রকোপের মতো পরিস্থিতির সময় পরিকল্পনা তৈরি এবং সেই অনুযায়ী কাজ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ খুবই দুর্বল অবস্থানে। জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে স্বাস্থ্যকর্মীদের যোগাযোগ অত্যন্ত নিম্ন স্তরে থাকে। নতুন প্রযুক্তি পরীক্ষা ও অনুমোদন দেওয়ার সক্ষমতা শূন্যের কোঠায়।সরকারের পক্ষে এ বিষয়ে কাজ করে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। আইইডিসিআরের পরিচালক দেশের বাইরে থাকায় তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

তবে সম্প্রতি সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা বলেছিলেন, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডেঙ্গু, নিপাহ্, কলেরা, রোটা ভাইরাস, জাপানিজ এনকেফেলাইটিস, মার্স করোনারি ভাইরাস অ্যানথ্রাক্স, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের ওপর তাঁরা নজরদারি করেন। নির্দিষ্ট কিছু হাসপাতাল, বিশেষ ঘটনা, গণমাধ্যম ও মুঠোফোনের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ, হটলাইনের মাধ্যমে আইইডিসিআর রোগের ওপর নজরদারি করে।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার একজন পরামর্শক বলেছেন, দুর্বল অবস্থা পৃথিবীর অনেক দেশেরই। কিন্তু সবচেয়ে খারাপ দিক হচ্ছে, বাংলাদেশে তথ্য লুকানো হচ্ছে। চিকুনগুনিয়া নিয়ে কী হয়েছিল, তার সঠিক চিত্র সরকার প্রকাশ করেনি। একই বিষয় ঘটছে ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে। জবাবদিহির অভাব প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে।

প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান যথেষ্ট ভালো, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে। প্রতিবেদনে জৈবনিরাপত্তা সম্পর্কে যে মূল্যায়ন করা হয়েছে, তার সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একমত নয়।

প্রতিবেদনে ৩৩টি সুপারিশ করা হয়েছে। এর শুরুতেই বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যনিরাপত্তার ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য সরকারগুলোকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। স্বাস্থ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি দেশের দক্ষতা কতটুকু, সে ব্যাপারে সরকারগুলোকে স্বচ্ছ অবস্থান নিতে হবে। স্বাস্থ্যসম্পর্কিত জবাবদিহি নিশ্চিত করা জন্য কমপক্ষে দুই বছর পর প্রতিবেদন প্রকাশ করা উচিত।

প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু ও বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশীদ–ই–মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, ‘মহামারির মতো কোনো পরিস্থিতি তৈরি হলে আমরা স্বাস্থ্যনিরাপত্তার কথা বলি বা ভাবি। অন্য সময় এ নিয়ে কোনো আলোচনা হয় না, আমরা শুনি না।’ তিনি বলেন, অনেক নতুন বিষয়, নতুন সূচক এই প্রতিবেদনে ব্যবহার করা হয়েছে। এসব বিষয়ে নীতিনির্ধারক ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীদেরও স্পষ্ট ধারণা আছে বলে মনে হয় না। এসব নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হওয়া দরকার। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।