বাংলাদেশে জঙ্গি হামলা কমেছে, প্রশ্ন বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে

বাংলাদেশে ২০১৮ সালে জঙ্গি হামলার হার এবং ব্যাপকতা আগের বছরের তুলনায় কমেছে। যদিও এ সময়ে জঙ্গি হামলায় একজন লেখক নিহত এবং একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গুরুতর আহত হয়েছেন। তবে সন্ত্রাসীদের বিচারপ্রক্রিয়া সফলভাবে শেষ করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা আর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সাফল্যকে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদবিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদ চিত্র বিশ্লেষণ করে এ মন্তব্য করা হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ওয়াশিংটনের সময় অনুযায়ী গত শুক্রবার ‘কান্ট্রি রিপোর্ট অন টেররিজম ২০১৮’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী সন্ত্রাসবাদবিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখার মধ্য দিয়ে পরিকল্পিত হামলা ঠেকাচ্ছে। সন্দেহভাজন জঙ্গিনেতাদের গ্রেপ্তার করছে। অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক জব্দ করছে। জঙ্গি ও জঙ্গিদের অভয়ারণ্য গড়ে তোলার বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ অব্যাহত রেখেছে সরকার। তবে জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের বিচারের প্রতিবন্ধকতা ও অভিযানের সময় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড জঙ্গিবিরোধী ব্যাপক সফলতাকে সমালোচনার মুখে ফেলছে।

মার্কিন প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার জঙ্গিদের কর্মকাণ্ডের জন্য স্থানীয়দের সম্পৃক্ততার বিষয়টি দাবি করে আসছে। যদিও ২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশে প্রায় ৪০টি হামলার ঘটনার দায় স্বীকার করেছে ভারতীয় উপমহাদেশের আল-কায়েদা (একেআই) এবং ইসলামিক স্টেট (আইএস)। জঙ্গি সংগঠনগুলো তাদের মতাদর্শ প্রচারের জন্য এবং বাংলাদেশ থেকে অনুসারী সংগ্রহের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করছে। আইএস ও আল-কায়েদাসংশ্লিষ্ট বেশ কিছু প্রকাশনা, ভিডিও ও ওয়েবসাইটে বাংলাদেশি যোদ্ধাদের প্রসঙ্গ এসেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক সন্ত্রাসবাদ প্রতিবেদনের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জঙ্গিদের বিষয়ে আগেভাগেই তথ্য জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে বলেই জঙ্গিবাদী হামলার বিরুদ্ধে সাফল্য এসেছে।’

জঙ্গিবাদ দমনে সাফল্যের ক্ষেত্রে বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে মার্কিন প্রতিবেদনের সমালোচনার জবাবে আনিসুল হক বলেন, ‘আইএসের প্রধান আবু বকর আল-বাগদাদির নিহত হওয়ার বিষয়টিকে কী বলবেন? বিচারবহির্ভূত হত্যা? মোটেই না। বাগদাদির মতো আমাদের এখানেও জঙ্গিদের ঘেরাও করার পর তারা নিজের ও পরিবারের সবার জীবন নিয়ে নেয়। এটি তাদের কাজের একটি ধারা। কাজেই তাদের ধরতে গেলে আত্মরক্ষার্থে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবস্থা নিতে হয়। এটিকে বিচারবহির্ভূত হত্যা বলে মন্তব্য করাটা তো ডাবল স্ট্যান্ডার্ড। তা ছাড়া জঙ্গি হামলায় জীবিতদের গ্রেপ্তারের পর যথাযথ বিচারপ্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে। এটি অভিজিৎ হত্যা আর জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও হত্যার বিচারেই প্রমাণিত।’

বাংলাদেশে জঙ্গি হামলায় হতাহত হওয়ার প্রসঙ্গে ২০১৮ সালের ৩ মার্চ আল-কায়েদাসংশ্লিষ্ট গ্রুপের সদস্য দাবি করা এক ব্যক্তির সিলেটে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক জাফর ইকবালের ওপর হামলা এবং ১১ জুন মুন্সিগঞ্জে লেখক ও রাজনৈতিক কর্মী শাজাহান বাচ্চুর হত্যার বিষয় দুটি উল্লেখ করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালেও বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা সন্ত্রাসবিরোধী আইন পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় ছিল। ২০০৯ সালের ওই আইনে ২০১২ ও ২০১৩ সালে সংস্কার আনা হয়। ৫ এপ্রিল সরকার বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো দুটি সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। সন্ত্রাসবিরোধী আইন অনুযায়ী ঢাকা ও চট্টগ্রামে ট্রাইব্যুনাল দুটি গঠন করা হয়। বাংলাদেশের সন্ত্রাসবিরোধী আইনে বিদেশি যোদ্ধা নিয়োগ ঠেকানোর পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতা থাকলেও দেশটি বিদ্যমান আইনের অধীনেই সন্দেহভাজন বিদেশি যোদ্ধা ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের গ্রেপ্তার করেছে।

জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযানে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিচারবহির্ভূত হত্যার সমালোচনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটসহ বাংলাদেশ পুলিশের অন্য সব সংস্থা সন্দেহভাজন জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান ও গ্রেপ্তার অব্যাহত রেখেছে। এসব অভিযানে অনেক সন্দেহভাজন নিহত হয়েছে, অনেক সময় এগুলোকে ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘শুটআউট’ বলে অভিহিত করা হয়।

বাংলাদেশ মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সন্ত্রাসবিরোধী কর্মসূচির সঙ্গে সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে এবং সংকট মোকাবিলা, প্রমাণ সংগ্রহের সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জঙ্গিবাদ দমনে জাতীয় কমিটি ইমাম ও মাওলানাদের নিয়ে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সচেতনতা কার্যক্রম চালাচ্ছে। পুলিশও জঙ্গিবিরোধী প্রচারণা মোকাবিলায় ধর্মীয় নেতাদের সহযোগিতা নিচ্ছে। কমিউনিটি পুলিশ কার্যক্রমও অব্যাহত রয়েছে। স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিখোঁজ শিক্ষার্থীদের সন্ধান ও শিক্ষার্থীদের সহিংস জঙ্গি পন্থায় জড়িয়ে পড়া ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ কাজ করছে।

জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, সন্ত্রাসবাদবিরোধী অভিযান পরিচালনায় আইনের শাসন মেনে চলাটা যে খুব গুরুত্বপূর্ণ, সে ব্যাপারে ওই প্রতিবেদনে ইঙ্গিত করা হয়েছে। সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া, যা কৌশলগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিচালনা বাঞ্ছনীয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রকাশিত কোনো কৌশলপত্র দেখতে পান না বলে তারা এটিকে একটি বড় দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করেছে।