প্রবাসে বাংলাদেশি শ্রমিকের মৃত্যুর কারণ যাচাই হয় না

সৌদি আরব থেকে গত ৩১ অক্টোবর দুপুরে গৃহকর্মী পারভিন আক্তারের লাশ দেশে আসে। তাঁর মৃত্যুসনদে লেখা ছিল ‘আত্মহত্যা’। যদিও এটি মানতে পারছেন না পরিবারের সদস্যরা। তাঁদের দাবি, সৌদি আরবে যাওয়ার পর থেকে তিনি অসংখ্যবার ফোনে নির্যাতনের অভিযোগ করেছিলেন। পারভিনের মৃত্যুর কারণ আসলে কী, তা বের করার উদ্যোগ নেই সরকারের। বিদেশে বাংলাদেশি কোনো শ্রমিকের মৃত্যুর কারণ যাচাই করে না সরকার।

পারভিনের বাড়ি মানিকগঞ্জে। পরিবারে সচ্ছলতা ফেরাতে গত বছর তিনি সৌদি আরবে যান, কিন্তু ফেরেন লাশ হয়ে। তাঁর স্বজন মাকসুদা বেগম বলেন, পারভিন আত্মহত্যা করেছেন—এমন খবর তাঁরা বিশ্বাস করেন না। তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে সেখানে।

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, গড়ে প্রতিদিন ১১ জন শ্রমিকের লাশ দেশে আসছে। চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে বিদেশ থেকে প্রায় ৩ হাজার লাশ এসেছে। এর মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ শ্রমিকের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। বাকিরা স্ট্রোক, হৃদ্‌রোগ, দুর্ঘটনা, হত্যা বা আত্মহত্যার শিকার। এর বাইরে অনেক প্রবাসীর লাশ বিদেশেই দাফন করা হয়। বিশেষ করে সৌদি আরবের ক্ষেত্রে এমনটা বেশি দেখা যায়।

অভিবাসন খাত নিয়ে কাজ করা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রবাসী কর্মীদের অস্বাভাবিক মৃত্যু তদন্তে বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর কোনো উদ্যোগ নেই। তাঁদের কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও নেই কোনো নজরদারি। বছরের পর বছর অস্বাভাবিক মৃত্যু বাড়তে থাকলেও তা প্রতিরোধে সরকার সক্রিয় হচ্ছে না বলে তাঁরা অভিযোগ করেছেন।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দায়সারাভাবে পরিবারকে মৃত্যুর কারণ বলে দেওয়াটা খুব অসম্মানজনক। মৃত্যুর কারণ অবশ্যই সরকারিভাবে যাচাই করা এবং তা প্রতিরোধে উদ্যোগী হওয়া উচিত।

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক গাজী মোহাম্মদ জুলহাস প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশে মৃত্যুর কারণ কখনো যাচাই করে দেখা হয়নি। দূতাবাস এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে।

গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ১ হাজার ৭৩৭টি মৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনা করেছে প্রথম আলো। এতে দেখা গেছে, ৬২ শতাংশ প্রবাসী মারা গেছেন স্ট্রোকে। স্বাভাবিক মৃত্যু পাওয়া গেছে ৫ শতাংশ প্রবাসীর।

>

স্বজনদের অভিযোগ, অনেক ক্ষেত্রে হত্যাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়।
১০ বছরে ২৬ হাজার ৭৫২ কর্মীর লাশ এসেছে বিদেশ থেকে।
গত ৯ মাসে এসেছে প্রায় তিন হাজার লাশ।

গত ২৭ অক্টোবর ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে প্রবাসীদের মৃত্যুর বিষয়ে জানতে চাইলে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, প্রবাসীদের মৃত্যুর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশ তদন্ত করে মৃত্যুসনদ দিয়ে থাকে।

এদিকে ২০১৬ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্য থেকে দেশে আসা ৩১১ নারীর লাশের তথ্য পর্যালোচনা করেছে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড। তাতে দেখা গেছে, আত্মহত্যা করেছেন ৫৩ নারী। ১২০ জনের স্ট্রোক ও ৫৬ জনের মৃত্যু ঘটেছে দুর্ঘটনায়। অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা একাধিক সংস্থা বলছে, নির্যাতন-নিপীড়নের মুখে বাধ্য হয়েই আত্মহত্যা করেন নারী শ্রমিকেরা। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে হত্যার পর আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত সত্য বের হচ্ছে না।

গত আগস্টে বিভিন্ন দেশ থেকে লাশ হয়ে ফিরেছেন ২৯৪ জন। তাঁদের মধ্যে সৌদি আরবে মারা গেছেন মৌলভীবাজারের শহিদুল মিয়া (২৭), মালয়েশিয়ায় সিরাজগঞ্জের আল আমিন (৩২), ওমানে লক্ষ্মীপুরের সুভাস চন্দ্র দেবনাথ (৩৩), কাতারে টাঙ্গাইলের আশরাফ আলী (২৭), আরব আমিরাতে কিশোরগঞ্জের আরাফাত আলী (২৭), ইতালিতে শরীয়তপুরের মনির হোসেন (২৮), দক্ষিণ আফ্রিকায় কেরানীগঞ্জের লোকমান (৩৩) ও সিঙ্গাপুরে মারা গেছেন চাঁদপুরের হোসেন আহমেদ (২৭)। তাঁরা সবাই স্ট্রোকে মারা গেছেন বলে মৃত্যুসনদে উল্লেখ করা হয়েছে।

নির্যাতিত অনেক প্রবাসী কর্মীর পরিবার যোগাযোগ করে মানবাধিকারকর্মী সালমা আলীর সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের নারীরা অত সহজে আত্মহত্যা করার মতো দুর্বল নন। অমানবিক যৌন নির্যাতনের শিকার হন নারীরা। তাঁদের আত্মহত্যা করানো হয়। আবার কখনো কখনো হত্যা করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। এগুলোকে খুন ছাড়া অন্য কিছু বলা যাবে না।’

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড সূত্র বলছে, বিদেশ থেকে লাশ আসা বাড়ছে। ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে দেশে বিদেশ থেকে লাশ এসেছে ২৬ হাজার ৭৫২টি। এগুলোর মধ্যে ২০১৫ সালে ৩ হাজার ৩০৭, ২০১৬ সালে ৩ হাজার ৪৮১, ২০১৭ সালে ৩ হাজার ৩৮৭ ও ২০১৮ সালে এসেছে ৩ হাজার ৭৯৩টি লাশ।

অভিবাসন খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অস্বাভাবিক মৃত্যু প্রতিরোধে সরকারের উদ্যোগী হওয়া উচিত। মৃত্যুর প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করাটা জরুরি। স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে দূতাবাসে বিশেষ দল তৈরি করতে পারে সরকার; যারা প্রতিটি মৃত্যু নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে কাজ করবে। ঘটনাস্থল, হাসপাতালে যাবে, যাচাই করবে। সংশ্লিষ্ট দেশের দায়িত্বশীলদের তদন্তে কোনো গাফিলতি দেখলে ওই দেশটির সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে।

বেসরকারি খাতে বিদেশে কর্মী পাঠানো প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বায়রার মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে বেসরকারি এজেন্সিগুলো তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে পারবে। কিন্তু এর মূল দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকে।