প্রকল্প পরিচালকসহ ৪ জন ও গণপূর্তের ২৯ প্রকৌশলীকে তলব

সাম্প্রতিক সময়ে ‘বালিশ-কাণ্ড’ নিয়ে আলোচিত দুর্নীতিসহ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুর্নীতি অনুসন্ধানে প্রকল্প পরিচালকসহ চারজন এবং গণপূর্তের ২৯ প্রকৌশলীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। রোববার দুদকের উপপরিচালক এবং এ–সংক্রান্ত অনুসন্ধান দলের প্রধান মো. নাসির উদ্দিন স্বাক্ষরিত চিঠিতে তাঁদের তলব করা হয়।

দুদক জানিয়েছে, পাবনা গণপূর্ত বিভাগের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুর রহমান ও অন্যদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে পাবনার রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের আসবাবপত্র ও অন্যান্য সামগ্রী অস্বাভাবিক দামে কেনা দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে সংস্থাটি।

প্রথম আলোকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য। সংশ্লিষ্টদের বিভিন্ন তারিখে দুদকে হাজির হতে বলা হয়েছে।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শৌকত আকবর, উপপ্রকল্প পরিচালক মো. হাসিনুর রহমান, উপসহকারী পরিচালক মাহবুব রহমান ও মেহেদি হাসানকে ১৩ নভেম্বর দুদকে হাজির হতে বলা হয়েছে। তাঁদের তলব করা চিঠি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর পাঠিয়ে নির্দিষ্ট দিনে হাজির করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

পাবনা গণপূর্ত বিভাগের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী (বর্তমানে রিজার্ভ, সেগুনবাগিচা) মাসুদুর রহমান, তিন উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. তারেক, তাহাজ্জুদ হোসেন ও মোস্তফা কামাল এবং তিন উপসহকারী প্রকৌশলী কামরুজ্জামান, আবু সাইদ ও ফজলে হককে ৬ নভেম্বর তলব করা হয়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এ কে এম জিল্লুর রহমান, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আহমেদ সাজ্জাদ খান, সহকারী প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম, উপসহকারী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম, সুমন কুমার নন্দী, শাহীন উদ্দিন ও জাহিদুল করিমকে ৭ নভেম্বর হাজির হতে বলা হয়েছে।

সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) শফিকুর রহমান, বর্তমান অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী নজিবর রহমান, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী দেবাশীষ চন্দ্র সাহা, সহকারী প্রকৌশলী রাকিবুল ইসলাম ও রওশন আলী, দুই উপসহকারী প্রকৌশলী আহসানুল হক ও খোরশেদা ইয়াছরিবাকে হাজির হতে বলা হয়েছে ১১ নভেম্বর।

সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম, বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল ইসলাম সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মকলেছুর রহমান, পাঁচ উপসহকারী প্রকৌশলী আলমগীর হোসেন, শাহনাজ আখতার, শফিউজ্জামান, রওশন আলী ও রফিকুজ্জামানকে ১২ নভেম্বর তলব করা হয়েছে।

গণপূর্তের ২৯ প্রকৌশলীকে নির্দিষ্ট তারিখে দুদকে হাজির হতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী বরাবর চিঠি পাঠানো হয়েছে।

রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের আবাসিক ভবনের জন্য ১৬৯ কোটি টাকার কেনাকাটায় পদে পদে দুর্নীতি হয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। এতে বলা হয়, গণপূর্ত অধিদপ্তরে কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন জোনভিত্তিক যে কেনাকাটা হয়ে থাকে, তার বার্ষিক একটি পরিকল্পনা থাকে। সে ক্ষেত্রে ৩০ কোটি টাকার নিচে কেনাকাটা হলে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের অনুমোদন লাগে না, স্থানীয় পর্যায়েই করা যায়। এর সুযোগ নিয়ে ১৬৯ কোটি টাকার কাজ ছয়টি প্যাকেজে ভাগ করা হয়। ফলে প্রতিটি কাজের মূল্য ৩০ কোটি টাকার নিচে হওয়ায় মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন প্রয়োজন পড়েনি।

সেখানে প্রতিটি বালিশ কিনতে খরচ দেখানো হয়েছে ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা। আর প্রতিটি বালিশ আবাসিক ভবনের খাটে তোলার মজুরি দেখানো হয়েছে ৭৬০ টাকা। কভারসহ কমফোর্টারের (লেপ বা কম্বলের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত) দাম ধরা হয়েছে ১৬ হাজার ৮০০ টাকা। যদিও এর বাজারমূল্য সাড়ে ৪ হাজার থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ১৩ হাজার টাকা। একইভাবে বিদেশি বিছানার চাদর কেনা হয়েছে ৫ হাজার ৯৩৬ টাকায়। এর বাজারমূল্য অবশ্য ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা।

পাঁচটি ২০ তলা ভবনের জন্য এসব কেনাকাটা হয়েছে। প্রতিটি তলায় রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট। প্রতিটি ফ্ল্যাটের জন্য কমফোর্টার শুধু বেশি দামে কেনাই হয়নি, কেনার পর দোকান থেকে প্রকল্প এলাকায় পৌঁছাতে আলাদা ট্রাক ব্যবহার করা হয়েছে। মাত্র ৩০টি কমফোর্টারের জন্য ৩০ হাজার টাকা ট্রাকভাড়া দেখানো হয়েছে। আর একেকটি কমফোর্টার খাট পর্যন্ত তুলতে ব্যয় দেখানো হয়েছে ২ হাজার ১৪৭ টাকা। কমফোর্টার ঠিকঠাকমতো খাট পর্যন্ত তোলা হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য তত্ত্বাবধানকারীর পারিশ্রমিক দেখানো হয়েছে প্রতিটির ক্ষেত্রে ১৪৩ টাকা। ঠিকাদারকে ১০ শতাংশ লাভ ধরে সম্পূরক শুল্কসহ সব মিলিয়ে প্রতিটি কমফোর্টারের জন্য খরচ দেখানো হয়েছে ২২ হাজার ৫৮৭ টাকা। শুধু কমফোর্টার নয়, চাদরের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে। ৩০টি চাদর আনতে ৩০ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি ট্রাক ভাড়া করা হয়েছে। আর ভবনের নিচ থেকে খাট পর্যন্ত তুলতে প্রতিটি চাদরের জন্য মজুরি দেখানো হয়েছে ৯৩১ টাকা।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে আসবাব কেনার ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়ম খতিয়ে দেখার জন্য গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি তদন্তে প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৩৪ জন কর্মকর্তার দুর্নীতি ও অনিয়মের সম্পৃক্ততা পেয়েছে। গত ২৭ জুলাই এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেন গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম।

ঘটনা তদন্তে দুটি উচ্চপর্যায়ের কমিটির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে গণপূর্তমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, দুটি কমিটির প্রতিবেদন পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়েছে যে ৩৪ জন কর্মকর্তা বা ব্যক্তি এ ঘটনায় নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। এর মধ্যে ৩০ জন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের। চারজন বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিভাগের।

শ ম রেজাউল করিম জানান, এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অনিয়ম করে ৩৬ কোটি ৪০ লাখ ৯ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এই টাকা ফেরত নেওয়া হবে। তাঁদের এখনো অনেক বিল পাওনা আছে। সেখান থেকে এই টাকা কেটে রাখা হবে।

প্রতিবেদনে ঠিকাদার সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চারটি ভবনে আসবাব ও ইলেকট্রনিক পণ্য সরবরাহের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো সাজিন এন্টারপ্রাইজ, মাজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন লিমিটেড ও জিকেপিবিএল-পায়েল-এইচএল কনসোর্টিয়াম। সাজিনের সরবরাহ করা মালামাল সবচেয়ে নিম্নমানের। সাজিন একাই পেয়েছে ১৪৬ কোটি টাকার তিনটি কাজ।

মাজিদ সন্স কনস্ট্রাকশনের সরবরাহ করা মাল সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘স্পেসিফিকেশন’ অনুযায়ী সরবরাহ করেনি। তবে জিকেপিবিএল-পায়েল-এইচএল কনসোর্টিয়ামের সরবরাহ করা মালামাল সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘অপেক্ষাকৃত ভালো’।

এদের মধ্যে সাজিন এন্টারপ্রাইজের মালিক শাহাদাত হোসেনের সঙ্গে পাবনা সদর আসনের সাংসদ গোলাম ফারুক খন্দকারের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। প্যাকেজে মোট ১৪৬ কোটি টাকার মধ্যে সাজিন এন্টারপ্রাইজ তিনটি কাজ পেয়েছে। একটি কাজ পেয়েছে মজিদ সন্স লিমিটেড। সাজিন এন্টারপ্রাইজের তিনটি কাজের মধ্যে একটি ২৯ কোটি ১৪ লাখ টাকার বিল গত বছরের অক্টোবরে পরিশোধ করা হয়েছে। তহবিলসংকটের কারণে অন্যরা বিল নিতে পারেনি। তবে এখন মন্ত্রণালয় চিঠি দিয়ে বিল দিতে নিষেধ করেছে।

জিকেপিবিএল সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া জি কে শামীমের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান।