প্রাণের পাশে সব সময় একদল 'রক্তযোদ্ধা'

ম. শহিদুল্লাহ তখন স্নাতকের ছাত্র। এক ঘটনার পর তাঁকে পেয়ে বসে ব্যতিক্রমী এক নেশায়। মানুষের জীবন বাঁচাতে রক্ত জোগাড় করে দেওয়া। এলাকার কয়েকজন তরুণকে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘প্রাণফোঁটা’। গত সাড়ে পাঁচ বছরে পাঁচ হাজারের বেশি রোগীর জন্য রক্ত সংগ্রহ করে দিয়েছে পিরোজপুরের এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। পরে জেলায় গড়ে উঠেছে আরও দুটি স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতা সংগঠন। তিন সংগঠন মিলে এখন স্বেচ্ছাসেবী রয়েছেন শতাধিক। তাঁরা শুধু নিজেরাই নিয়মিত রক্ত দেন না, অন্যদের রক্তদানে উৎসাহিত করেন। প্রয়োজনের সময় নানাভাবে চেষ্টা করে রক্তের ব্যবস্থা করে দেন। এভাবে মানুষের জীবন বাঁচাতে রাতদিন কাজ করে যাচ্ছেন এই রক্তযোদ্ধারা।

শহিদুল্লাহ জানালেন সেই শুরুর কথা। প্রতিবেশী এক নারী অন্তঃসত্ত্বা। সন্তান জন্মদানের জন্য অস্ত্রোপচার হবে। ও পজিটিভ রক্তের প্রয়োজন। তবে অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেও মিলছিল না রক্ত। পরে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা থেকে এলেন এক আত্মীয়। চার ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে এসে রক্ত যখন দিলেন, ততক্ষণে ওই নারীর অবস্থা সংকটাপন্ন। ওই ঘটনা রেখাপাত করে শহিদুল্লাহর মনে। এরপর তিনি পাঁচজনকে নিয়ে গড়ে তোলেন প্রাণফোঁটা। স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংগঠনটির স্লোগান ঠিক করা হয় ‘প্রাণের পাশে সব সময়’। ২০১৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠা করা হয় প্রাণফোঁটা। এরপর থেকে প্রতি মাসে শতাধিক রোগীকে রক্তদাতা খুঁজে দিচ্ছে সংগঠনটি।

প্রধান উদ্যোক্তা ম. শহিদুল্লাহ (২৯) পিরোজপুর পৌরসভার মাছিমপুর মহল্লার বাসিন্দা। শুরুতে আরও যে পাঁচজন সংগঠনে যুক্ত হন, তাঁরা হলেন একই মহল্লার ইমাম হোসেন তালুকদার (২৯) ও মশিউর রহমান (২৪), জুজখোলা গ্রামের নাঈম মাহামুদ (২৫), কুমারখালী গ্রামের আবির খান (২৫)। সংগঠন প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই এই পাঁচজন নিজেরা রোগীদের রক্ত দান করতেন। সংগঠন প্রতিষ্ঠার পর তাঁরা বন্ধু ও স্বজনদের রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে সংগঠনের কার্যক্রমের পরিধি বাড়তে থাকে। শুরু হয় ফেসবুক, প্রচারপত্র বিলি, সচেতনতামূলক প্রচারণাসহ নানা মাধ্যমে প্রচারণা। এভাবে গত সাড়ে পাঁচ বছরে সংগঠনে স্বেচ্ছায় রক্তদাতার সংখ্যা পৌঁছায় তিন হাজার। তাঁদের কাছ থেকে রক্ত নিয়ে এ পর্যন্ত পাঁচ হাজারের বেশি রোগীকে দেওয়া হয়েছে। সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবী সদস্য বেড়ে হয়েছে ৬০।

স্বেচ্ছাসেবী এস এম জিয়াউল ইসলাম বলেন, ‘আমরা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করি। ঈদের ছুটিতে মানুষজন স্বজনদের সঙ্গে সময় কাটান। অনেকে হাসপাতালে অসুস্থ স্বজনকে রেখে বাড়িতে ঈদ করতে চলে যান। আমরা এমন রোগীর পাশে দাঁড়াই। রক্তের ব্যবস্থা করে দিয়ে তাঁর সঙ্গে ঈদের আনন্দ উপভোগ করি। অনেক সময় গভীর রাতে অনেকে রক্তের জন্য ফোন করেন। তখন রক্তদাতা সংগ্রহ করে দিতে হয়। রক্ত পাওয়ার পর রোগীকে যখন সুস্থ হতে দেখি, তখন সব কষ্ট ভুলে যাই।’

প্রাণফোঁটার পর পিরোজপুরে ২০১৭ সালের ১৪ জুন গড়ে ওঠে ‘রক্তের বন্ধন’। এই সংগঠনে আছেন ৩০ জন স্বেচ্ছাসেবী। পরে হয়েছে ‘প্রাণের ছোঁয়া’ নামের আরেকটি রক্তদাতা সংগঠন। অপেক্ষাকৃত নতুন এই সংগঠনে স্বেচ্ছাসেবী আছেন পাঁচজন। তিনটি সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরাই বিপদের সময় রক্তের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন নিঃস্বার্থভাবে। দিনে দিনে তাঁরা হয়ে উঠেছেন পিরোজপুরের মানুষের দুঃসময়ের ভরসার জায়গা।

রক্তের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করে দেওয়ার কাজও করে থাকে এসব সংগঠন। পাশাপাশি গ্রামের মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতাবিষয়ক প্রচারণা, প্রসূতি ও নবজাতকের স্বাস্থ্য সুরক্ষাসহ নানা কার্যক্রম আছে তাদের। সংগঠনের সদস্য ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের দেওয়া অর্থ দিয়ে চলে এসব কার্যক্রম।

সুবিধাভোগীদের কথা

পিরোজপুর পৌরসভার মুসলিমপাড়া মহল্লার মহিমা আক্তারের (৭) সাড়ে পাঁচ বছর বয়সে থ্যালাসেমিয়া ধরা পড়ে। দুই মাস অন্তর শিশুটিকে তিন ব্যাগ রক্ত দিতে হয়। মহিমার বাবা প্রবাসী। রক্ত জোগাড় করতে গিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হতো মা সাহিদা ইয়াসমিনের। প্রাণফোঁটার সঙ্গে যোগাযোগ হওয়ার পর সব কষ্ট ঘুচে গেছে তাঁর।

সাহিদা ইয়াসমিন বলেন, ‘প্রাণফোঁটার স্বেচ্ছাসেবীরা আমার মেয়ের রক্ত সংগ্রহ করে দেন। এখন আর আমার মেয়ের রক্তের জন্য মানুষের কাছে ঘুরতে হয় না। প্রাণফোঁটাকে কয়েক দিন আগে জানিয়ে দিলেই রক্তের ব্যবস্থা হয়ে যায়।’

একইভাবে ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত পিরোজপুর পৌরসভার মাছিমপুর মহল্লার বাসিন্দা রফিক খান (৫৫), থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত ভান্ডারিয়া উপজেলার মুনিয়া আক্তার (৪), পিরোজপুর পৌরসভার নামাজপুর মহল্লার জিহাদ হোসেনসহ (৭) মোট ২৫ জনকে নিয়মিত রক্তের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে প্রাণফোঁটা। রক্তের বন্ধন নিয়মিত আটজনকে রক্তের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। প্রাণের ছোঁয়া মাসে গড়ে ১৫ জনের জন্য রক্তের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।

পিরোজপুরের সিভিল সার্জন ফারুক আলম বলেন, স্বেচ্ছাসেবী এই রক্তদাতা সংগঠন তিনটি এখন জেলার রোগীদের ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে। তাঁরা জরুরি প্রয়োজনের সময় এসব সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করে সহজেই রক্ত পাচ্ছেন। মানুষের জীবন বাঁচাতে তরুণদের এই উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে।