আদা চাষে অভাব দূর

নিজের আদাখেত পরিচর্যায় ব্যস্ত কৃষক আবেদ আলী। সম্প্রতি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার দৌলতপুর গ্রামে।  ছবি: প্রথম আলো
নিজের আদাখেত পরিচর্যায় ব্যস্ত কৃষক আবেদ আলী। সম্প্রতি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার দৌলতপুর গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামের আবেদ আলীর বসতভিটা ছাড়া কোনো জমি ছিল না। তারাগঞ্জ হাটে অন্যের গরু-ছাগল কিনে দিয়ে যা পেতেন, তা দিয়ে কোনোরকমে সংসার চালাতেন। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে প্রায় উপোস থাকতে হতো তাঁকে। আট বছর আগে আবেদ আলীর অবস্থা ছিল এ রকম। আর আজ তিনি সফল চাষি, টিনের বাড়ি, ৭৫ শতক জমির মালিক। তাঁর সাফল্য দেখে আদা চাষ করে কুর্শা ইউনিয়নের দুই শতাধিক কৃষক ভাগ্য বদল করেছেন।

তারাগঞ্জ উপজেলা পরিষদের এক কিলোমিটার উত্তর দিকে দৌলতপুর গ্রাম। ওই গ্রামে আবেদ আলীর বাড়ি। ফসলাদি ভালো হতো না বলে অভাব লেগেই ছিল গ্রামটিতে। একফসলি জমি ছিল গ্রামবাসীর একমাত্র ভরসা। কিন্তু এখন শুধু ওই গ্রামেই নয়, পুরো ইউনিয়নের চিত্র বদলে গেছে। কৃষকের অভাব দূর করেছে আদা, মরিচ ও বেগুনের ফলন।

আবেদ আলী জানান, ১৯৭০ সালে দরিদ্র পরিবারে জন্ম তাঁর। বাবার অভাবের সংসার, তাই পঞ্চম শ্রেণিতে উঠেই লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। বাবার সঙ্গে শুরু করেন দিনমজুরি। বাবা মারা যাওয়ার পর ২০০০ সালে বিয়ে করেন। এলাকায় কাজ না থাকায় তারাগঞ্জ হাটে গিয়ে অন্যকে গরু–ছাগল কিনে দিতেন। এতে যা পেতেন, তা দিয়ে দুবেলা খাবার জুটত না। তাঁর কষ্টের কথা শুনে ২০১২ সালে থানাপাড়া গ্রামের নুর হোসেন তাঁকে আদা, মরিচ ও বেগুন চাষের পরামর্শ দেন।

আবেদ আলী ১০ শতক বসতভিটায় আদার চাষ করেন এবং সাথি ফসল হিসেবে আদাখেতে লাগান মরিচ ও বেগুন। ৯ মাস পর আদার ফলন দেখে আবেদ আলীর মুখে হাসি ফোটে। বিক্রি করে আয় হয় ৩০ হাজার টাকা। এরপর অন্যের জমি বর্গা নিয়ে আদা চাষে লেগে পড়েন। স্ত্রী, সন্তানও তাঁর সঙ্গে কাজে হাত লাগান। এভাবে একপর্যায়ে আবেদ আলী হয়ে ওঠেন সফল চাষি। কেনেন ৭৫ শতক জমি, বানান টিনের বাড়ি। আদা চাষের আয়ে দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। এবার ৮০ শতকে করেছেন আদার চাষ। ওই আদাখেতে সাথি ফসল হিসেবে বেগুন, মরিচ আবাদ করে আয় করেছেন ৫৫ হাজার টাকা। খেতে এখন যে পরিমাণ আদা আছে, তা বিক্রি করলে খরচ বাদে আয় হবে দুই লাখ টাকা।

বুড়িরহাট গ্রামের আদাচাষি ফত্তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আদা হামারও কপাল খুলি দিছে। ৩০ হাজার টাকা খরচ করি এইবার মুই ৩৫ শতক জমিত আদা গারছুনু। আদাখেতে আনা সমস্যা দেখা দিছলো। ওই জন্যে তাক আগোত তুলি ১৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করি ৯৫ হাজার টাকা পাছুন। খরচ বাদ দিয়া লাভ হইছে ৬৫ হাজার টাকা।’

আদার চাষ করে পাকা বাড়ি, তিন একর জমি কিনেছেন রহিমাপুর গ্রামের ফয়সাল হোসেন। তিনি বলেন, ধানের চেয়ে আদা চাষে লাভ বেশি। এক একরে আমন ধান চাষ করতে ব্যয় হয় ২০-২২ হাজার টাকা। উৎপাদিত ধান বিক্রি হয় ৩০-৩২ হাজার টাকা। লাভ ৮-১০ হাজার টাকা। কিন্তু এক একরে আদা চাষে ব্যয় হয় ৮০-৯০ হাজার টাকা। বিক্রি হয় আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা। একরে আদা চাষ করে আয় আসে ১ লাখ ৭০ হাজার থেকে ২ লাখ ১০ হাজার টাকা। মুনাফা হেরফের হয় মূলত আদার উৎপাদন ও বাজারদরের কারণে।

উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা বিশ্বনাথ সরকার বলেন, আবেদ আলী কৃষকদের মডেল। তাঁকে দেখে ইউনিয়নের দুই শতাধিক কৃষক আদা, মরিচ ও সবজির চাষ করছেন। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ ও রোগবালাই দমনের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা অশোক কুমার বলেন, দিন যতই যাচ্ছে, তারাগঞ্জে আদা চাষ ততই বাড়ছে। লাভ বেশি হওয়ায় ধান ছেড়ে অনেক কৃষক আদা চাষে ঝুঁকছেন। মার্চ মাসে জমি চাষ করে আদা রোপণ করা হয়। নভেম্বর-ডিসেম্বরে খেত থেকে আদা তোলা হয়। সাথি ফসল হিসেবে আদাখেতে মরিচ, বেগুন চাষ করা যায়।