মনের জোরে প্রতিবন্ধিতা জয়

বাঁশ-বেতের তৈরি সামগ্রী বিক্রি করছেন প্রদীপ কুমার দাশ। গত বুধবার বিকেলে সীতাকুণ্ড থানা এলাকায় পুরোনো ভূমি কার্যালয়ের সামনে।  প্রথম আলো
বাঁশ-বেতের তৈরি সামগ্রী বিক্রি করছেন প্রদীপ কুমার দাশ। গত বুধবার বিকেলে সীতাকুণ্ড থানা এলাকায় পুরোনো ভূমি কার্যালয়ের সামনে। প্রথম আলো

শরীরের মেরুদণ্ড ভাঙা। কোমরের নিচের অংশ অবশ। দুটি হাত ও মনের জোরে হুইলচেয়ারে বসে প্রতিবন্ধিতা জয় করেছেন সীতাকুণ্ডের প্রদীপ কুমার দাশ। অন্যের ওপর নির্ভরশীল হননি। বাঁশ-বেতের তৈরি নিত্যপ্রয়োজনীয় গৃহস্থালি পণ্যের ব্যবসা করে চালান সংসার। তাঁর কথায়, নিজের আয়ের ডালভাতেও অনেক স্বাদ। ২৩ বছর বয়সে পা হারান, এখন তাঁর বয়স ৪৭।

সীতাকুণ্ড থানা কার্যালয়ের সামনেই পুরোনো ভূমি কার্যালয়ের দেয়ালঘেঁষে তার বাঁশ-বেতের তৈরি গৃহস্থালি ও কৃষিকাজে ব্যবহৃত পণ্যের দোকান। দেয়ালঘেঁষে থরে থরে সাজানো রয়েছে বাঁশের লাই, খাঁচা, কুলা, ঝুড়ি, বেড়া ইত্যাদি। পেছনে রয়েছে একটি ছোট গুদাম।

গত বুধবার বিকেলে দোকানেই কথা হয় তাঁর সঙ্গে। প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, একেক দিনে একেক রকম বেচাকেনা হয়। তবে মাস শেষে গড়ে ১০ হাজারের কিছুটা বেশি আয় হয়। তা দিয়ে চলে যায়।

প্রদীপ কুমার দাশ প্রথম আলোকে বলেন, ষষ্ঠ শ্রেণির বেশি পড়াশোনা হয়নি। ঝালাইয়ে কাজ শিখে শুরু করেন জীবনসংগ্রাম। কিছুদিন দরজা, জানালা ও গ্রিল তৈরির দোকানে কাজ করেন। পরে কাজ শুরু করেন ঠিকাদারের অধীনে।

কিভাবে পা হারান সেই ঘটনা জানালেন প্রদীপ কুমার দাশ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৯৭ সালের অক্টোবর মাসের একদিন বিকেলে টিএসপি সার কারখানার একটি গুদাম নির্মাণের কাজ করছিলেন। উচ্চতা তিনতলা ভবনের সমান। চালের ওপরে টিন বসানোর জন্য অ্যাঙ্গেল লাগাচ্ছিলেন। ঘটনার দিন সকাল থেকে কাজ করছিলেন তিনি। দুপুরে খাবার খেয়ে এসে আবারও কাজ শুরু করেন। হঠাৎ ওপর থেকে নিচে পড়ে যান। অন্যরা তাঁকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (চমেক) ভর্তি করান। তিন দিন পর জ্ঞান ফিরে দেখেন তিনি হাসপাতালের বেডে। পাঁচ দিন চমেকে চিকিৎসার পর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকার সাভারে সিআরপি হাসপাতালে। সেখানে তিন মাস চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফেরেন। টাকাপয়সার অভাবে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা হয়নি। দুই বছর ভালো ছিলেন। পরে তাঁর কোমর থেকে নিচের অংশ অবশ হয়ে যায়।

তাঁর দোকানটি স্থানীয় মানুষের কাছে হুইলচেয়ার প্রদীপের দোকান নামে পরিচিত। দাম সহনীয় পর্যায়ে রেখে ভালো জিনিস বিক্রি করায় মানুষও তাঁর ওপর ভরসা করেন। অনেকে ফোন করে জিনিসের ফরমাশ করেন কিংবা লোক পাঠিয়ে দেন।

 স্থানীয় কারিগরদের থেকে কিনে নিয়ে তিনি বিক্রি করেন। মোট ১০টি কারিগর পরিবার জিনিসপত্র তৈরি করে তাঁর কাছে বিক্রি করেন। তিনিও কোনো জিনিস লাগলে কারিগরদের কাছে ফোন দেন। অসুবিধা হলো কারিগরদের বাড়ি থেকে দোকান পর্যন্ত জিনিসপত্র আনা। অনেক সময় আনার লোক পাওয়া যায় না। বর্তমানে তাঁর গুদামে ৬০ হাজার টাকার জিনিস রয়েছে বলে জানান তিনি।

প্রদীপ কুমার দাশের দাদার বাড়ি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলায়। বাবা বাদল দাশ চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গা থানাধীন স্টিল মিলে চাকরি করার সুবাদে প্রদীপের জন্ম ও বেড়ে ওঠাও সেখানে। এখন থাকছেন মামার বাড়ি সীতাকুণ্ড পৌর সদরের মল্লিক বাড়িতে। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। বিয়ে করেননি। অপর দুই ভাই ও এক বোন বিয়ের পর আলাদাভাবে থাকেন। তিনি সমাজসেবা কার্যালয় থেকে প্রতিবন্ধী ভাতা পান। প্রতি মাসে ৭০০ টাকা করে ভাতা পান।

সীতাকুণ্ড উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা লুৎফুন্নেছা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, প্রদীপ কুমার দাশ অন্যদের জন্য অনুকরণীয়। ইচ্ছা থাকলে কারও মুখাপেক্ষী না থেকে নিজেই কিছু করে আয় করা যায়।