সহিংসতার শঙ্কায় ৯ বছর ধরে রাজশাহী পলিটেকনিক ছাত্রাবাস বন্ধ

ছাত্রলীগের সহিংসতায় শিক্ষার্থী খুনের জেরে ৯ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের দুটি ছাত্রাবাস। আর ছাত্রীনিবাস সাত বছর বন্ধ থাকার পর খুলেছে। ছাত্রাবাস বন্ধ থাকায় অতিরিক্ত খরচ করে বাইরে থাকতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। এতে অনেক শিক্ষার্থী হিমশিম খান। ফের সহিংসতার আশঙ্কায় কর্তৃপক্ষ ছাত্রাবাস খুলে দেওয়ার সাহসও পাচ্ছে না।

এর মধ্যে অন্যায় আবদার না মেনে নেওয়ায় গত শনিবার ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ ফরিদ উদ্দীন আহম্মেদকে টেনে-হিঁচড়ে পুকুরে ফেলে দেন ছাত্রলীগের কর্মীরা। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের ৯ কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। তবে মূল অভিযুক্তরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাঁদের গ্রেপ্তারের দাবিতে আন্দোলন চলছে।

ইনস্টিটিউট সূত্র জানায়, ২০১০ সালের ৭ জানুয়ারি ছাত্র মৈত্রীর পলিটেকনিক শাখার সহসভাপতি রেজওয়ানুল ইসলাম চৌধুরীকে ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা কুপিয়ে হত্যা করেন। ওই হামলায় ছাত্র মৈত্রীর আরও কিছু নেতা–কর্মী গুরুতর আহত হন। ওই ঘটনায় কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য পলিটেকনিক ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করে এবং শিক্ষার্থীদের ছাত্রাবাস ত্যাগের নির্দেশ দেয়। এর ৪ মাস ১৯ দিন পর ২০১০ সালের ২৬ মে ক্যাম্পাস খুলে দেওয়া হলেও ছাত্রাবাস চালু হয়নি। সর্বশেষ ২০১৭ সালের মাঝামাঝি একটি ছাত্রীনিবাস খুলে দেওয়া হয়।

রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ক্যাম্পাসে শাহ নেয়ামতুল্লাহ (রহ.) ছাত্রাবাস, শহীদ মনোয়ার ছাত্রাবাস ও আক্তারুন্নেসা ছাত্রীনিবাসে ৩০০ শিক্ষার্থীর আবাসনব্যবস্থা রয়েছে। এর মধ্যে শাহ নেওয়ামতুল্লাহ (রহ.) ছাত্রাবাসে ১৪০টি, শহীদ মনোয়ার ছাত্রাবাসে ৮০ ও আক্তারুন্নেসায় ৮০টি আসন রয়েছে।

ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ জানায়, আগে ক্যাম্পাসের ছাত্রাবাস এলাকা শিক্ষার্থীদের পদচারণে সব সময় মুখরিত থাকত। এখন শাহ নেয়ামতুল্লাহ (রহ.) ও শহীদ মনোয়ার ছাত্রাবাসে যেন ভুতুড়ে পরিবেশ। সুনসান নীরবতা। যাতায়াতের রাস্তাগুলো এখন জঙলায় পরিণত হয়েছে। দেয়াল থেকে পলেস্তারা খসে পড়ে গেছে। ছাত্রাবাসের বারান্দার গ্রিল বেয়ে উঠেছে লতাপাতা। গেটের তালায় মরিচা ধরেছে।

২০১৭ সালে আক্তারুন্নেসা ছাত্রীনিবাসটি খুলে দেওয়া হয়েছে বলে জানায় ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ছাত্রদের এখনো বাইরেই থাকতে হচ্ছে। ২০১০ সালের ঘটনার পর ছাত্রলীগের পলিটেকনিক শাখার কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। তারপর নতুন করে আবার তাদের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বিশৃঙ্খলাও লেগেই থাকে।

ইনস্টিটিউটের সপ্তম সেমিস্টারের এক শিক্ষার্থী বলেন, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে তাঁর শিক্ষাজীবন প্রায় শেষ হয়ে এল। পুরোটা সময় তাঁকে বাইরের মেসে থাকতে হলো। তিনি বলেন, মেসে এক হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে একটি ছোট্ট কক্ষে কয়েকজন গাদাগাদি করে থাকতে হয়। ক্যাম্পাসের ছাত্রাবাসও খুলে দেওয়া হচ্ছে না। বাইরে থাকার খরচও বেশি। নিরুপায় হয়ে থাকতে হয়। তৃতীয় সেমিস্টারের এক শিক্ষার্থী বলেন, ক্যাম্পাসে থাকতে পারলে অনেক বিষয়ে বই কিনতে হতো না। সহপাঠী এবং বড় ভাইদের সহযোগিতা নিয়ে ও পাঠাগারে পড়াশোনা করলেই হতো। কিন্তু বাইরের মেসে এই সব সুযোগ–সুবিধা নেই। বাইরে খরচ বেশি, কষ্টও বেশি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের কারণে মাঝেমধ্যেই ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল হয়ে উঠে। কারণ, তাঁরা অন্য সংগঠনের নেতা–কর্মীদের ওপর হামলা করেন। আবার মাঝেমধ্যে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর নবীনবরণ অনুষ্ঠানে বেলুন ফাটানো নিয়ে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা। এ সময় এক কর্মীর হাতের আঙুল কেটে ফেলা হয়।

গতকাল মঙ্গলবার রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে পুলিশ পাহারায় রয়েছে। অল্প কিছু শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে ক্লাস করছেন। ঘটনার পর থেকে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের জন্য আন্দোলন করেছেন। কিন্তু নাম প্রকাশ করে কেউ বক্তব্য দিতে চাননি।

একজন ছাত্রী প্রথম আলোকে বলেন, অধ্যক্ষকে ফেলে দেওয়ার ঘটনাটি তাঁর চোখের সামনেই ঘটেছে। তিনি বলেন, ছাত্রলীগের সঙ্গে বহিরাগতদের বেশি ঘুরতে দেখা যায়। তাঁরা ছাত্রীদের ফোন নম্বর নিয়ে উত্ত্যক্ত করেন। ফেল করা শিক্ষার্থীদের পাস করানোর জন্য টাকা নেন। শিক্ষকেরা তাঁদের কথা না শুনলেই এ ধরনের ঘটনা ঘটে।

ছাত্রাবাস খুলে দেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে অধ্যক্ষ ফরিদ উদ্দীন আহম্মেদ গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, যখন ছাত্রাবাস বন্ধ করা হয়েছে, তখন তিনি অধ্যক্ষ ছিলেন না। তিনি ২০১৭ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর মেয়েদের ছাত্রীনিবাস খুলে দিয়েছেন। ছাত্রাবাস দুটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে গেছে। দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। মেরামত করা হলেই ছাত্রদের ওঠানোর ব্যবস্থা করা হবে।

তবে ইনস্টিটিউটের একজন কর্মকর্তা বলেন, ক্যাম্পাসেই ছাত্রলীগ সহিংসতা করে বেড়ায়। ছাত্রবাস খুলে দিলে তা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সহিংসতার মাত্রা আরও বাড়তে পারে। সেই আশঙ্কার কারণেই ছাত্রাবাস খুলে দেওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছেন না তাঁরা।

মিডটার্ম পরীক্ষায় ফেল এবং ক্লাসে অনুপস্থিত থাকা পলিটেকনিক শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক কামাল হোসেন ওরফে সৌরভকে ফাইনাল পরীক্ষায় সুযোগ দেওয়ার জন্য গত শনিবার দুপুরে নেতা–কর্মীরা অধ্যক্ষ ফরিদ উদ্দীন আহম্মেদের কার্যালয়ে গিয়ে চাপ দেন। এ নিয়ে অধ্যক্ষের সঙ্গে তাঁদের তর্কবিতর্ক হয়। এর জের ধরে দুপুরে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা অধ্যক্ষকে টেনেহিঁচড়ে ক্যাম্পাসের ভেতরের একটি পুকুরে ফেলে দেন। এ ঘটনার পর ছাত্রলীগের পলিটেকনিক শাখার কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ছাত্রলীগ ৯ কর্মীকে।