'আমি না পারলেও অন্য কোনো সুদীপ হয়তো সুযোগ পাবেন'

সুদীপ দাস। এ পর্যন্ত দুই বার সহকারী জজ নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের প্রবেশপত্র পেয়েছেন। ২০১৭ সালে প্রবেশপত্র পেলেও পরীক্ষা দেননি। আর গত বছর সাদা খাতা জমা দিয়ে পরীক্ষার হল থেকে বের হয়েছেন। পরীক্ষার হলে যে সময়টুকু ছিলেন অন্যদের সহায়তায় নামসহ শুধু টুকটাক তথ্য পূরণ করেছেন। এবারও বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের (বিজেএসসি) ১৩ তম সহকারী জজ নিয়োগ পরীক্ষার জন্য প্রবেশপত্র পেয়েছেন। ৮ নভেম্বর, শুক্রবার পরীক্ষা। এবারও হয়তো সাদা খাতাই জমা দিতে হবে। কেননা, সুদীপ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, তাই পরীক্ষা দিতে হলে শ্রুতিলেখকের সহায়তা লাগে। কিন্তু এই শ্রুতিলেখকের অনুমতিই পাওয়া যাচ্ছে না। এবারও শ্রুতিলেখকের অনুমতি মেলেনি।

তারপরও ২৯ বছর বয়সী সুদীপ যুদ্ধটা চালিয়ে যেতে চান। তাঁর ভাষায়-‘আমি না পারলেও অন্য কোনো সুদীপ হয়তো সুযোগটা পাবেন’।

অন্যবার সুদীপ প্রবেশপত্র পাওয়া এবং পরীক্ষার সময়সূচি মিলিয়ে আইনি সহায়তা নেওয়ার সুযোগ পাননি। এবার আজ বুধবার সুদীপের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী কুমার দেবুল দে হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করেছেন। আজ দুপুরে এই রিট আবেদন আদালত গ্রহণ করেছেন। কাল বৃহস্পতিবার সকালে শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।

সুদীপ ছোট বেলা থেকেই ক্ষীণদৃষ্টি সম্পন্ন। এক চোখে কিছুটা দেখতেন। চোখের সামনে বই নিয়ে পড়তে হতো। তবে আস্তে আস্তে দুই চোখের দৃষ্টি চলে যায়। ছবি: মানসুরা হোসাইন
সুদীপ ছোট বেলা থেকেই ক্ষীণদৃষ্টি সম্পন্ন। এক চোখে কিছুটা দেখতেন। চোখের সামনে বই নিয়ে পড়তে হতো। তবে আস্তে আস্তে দুই চোখের দৃষ্টি চলে যায়। ছবি: মানসুরা হোসাইন

কুমার দেবুল দে বললেন,‘দেশের সংবিধান সব নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করেছে। ২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনের ১৬ ধারায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সম্পর্কে ঝ উপধারায় সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মে নিযুক্তিতে সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করেছে। অথচ সুদীপ শ্রুতিলেখকের অনুমতি পাচ্ছেন না বলে পরীক্ষা দিতে পারছেন না। আইনের ঝ উপধারা প্রয়োগে বিরত থাকাকে কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এবং সুদীপের পরীক্ষায় যাতে শ্রুতিলেখকের অনুমতি দেওয়া হয় তার আবেদন করেছি। বিচারক নিয়োগের পরীক্ষায় সুদীপ যদি অংশ নিতে না পারেন তাহলে তাঁকে আইন বিষয়ে পড়ার অনুমতি কেন দেওয়া হলো?’

কুমার দেবুল দে জানালেন, সুদীপ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগের ছোট ভাই। এ ছাড়া প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার নিশ্চিতের জন্যই তিনি রিট দায়েরে এগিয়ে এসেছেন। বললেন,‘আদালত যেহেতু রিটটি গ্রহণ করেছেন, তাই আমি আশাবাদী হয়তো সুদীপের পক্ষে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত পাব।’

আজ সকালে হাইকোর্টে সুদীপকে সহায়তা করছিলেন তাঁর এক বন্ধু ডালিয়া আক্তার। তিনি জানালেন, সুদীপের বিভিন্ন প্রয়োজনে পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি তাঁরা বন্ধুরা যখন যিনি সময় পান সহায়তা করার চেষ্টা করেন। সুদীপ ও ডালিয়া রিট দায়েরের বিভিন্ন প্রস্তুতির ফাঁকেই কথা বলেন।

ময়মনসিংহের ছেলে সুদীপ। বর্তমানে থাকেন চট্টগ্রামে। ২০০৭ সালে এসএসসি এবং ২০০৯ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন সুদীপ। ২০১৬ সালে সেখান থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেন। সুদীপ ছোট বেলা থেকেই ক্ষীণদৃষ্টি সম্পন্ন। এক চোখে কিছুটা দেখতেন। চোখের সামনে বই নিয়ে পড়তে হতো। তবে আস্তে আস্তে দুই চোখের দৃষ্টি চলে যায়। তাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে পড়ার সময় বন্ধুরা তাঁকে পড়ে পড়ে মোবাইলে রেকর্ড করে দিতেন। সুদীপ শুনে শুনে পড়তেন।

সুদীপের পাশে রয়েছেন তাঁর বন্ধুরা। বিভিন্ন প্রয়োজনে পরিবারের পাশাপাশি তারাও সহায়তা করেন। রিট আবেদনে সাহায্য করতে চলে আসেন বন্ধু ডালিয়া। ছবি: মানসুরা হোসাইন
সুদীপের পাশে রয়েছেন তাঁর বন্ধুরা। বিভিন্ন প্রয়োজনে পরিবারের পাশাপাশি তারাও সহায়তা করেন। রিট আবেদনে সাহায্য করতে চলে আসেন বন্ধু ডালিয়া। ছবি: মানসুরা হোসাইন

সুদীপ জানালেন, ক্ষীণদৃষ্টি হওয়ার কারণে ১০০ ওয়াটের টেবিল ল্যাম্প চোখের সামনে নিয়ে লেখাপড়া করতে হতো। বাল্বের প্রচণ্ড তাপে মাথা গরম হয়ে গেলেও পড়াশোনা থামাননি।

সুদীপের বাবা প্রদীপ চন্দ্র দাস রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। মা মীরা দাস একটি সরকারি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক। তিন ভাইবোনের মধ্যে সুদীপ দ্বিতীয়। সুদীপের বড় বোন একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। ছোট বোন পড়াশোনা করছেন।

সহকারী জজের নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে সুদীপ বললেন,‘আমি আইনে পড়াশোনা করেছি, তাই সর্বোচ্চ পর্যায়েই চাকরি করতে চাই। আমাদের দেশে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী আইনজীবী আছেন। ভারতসহ অন্যান্য দেশে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বিচারক হচ্ছেন। তাই আমিও একজন বিচারক হতে চাই। পরীক্ষার হলে সাদা খাতা জমা দিয়ে আসা ছিল একটি নীরব প্রতিবাদ। চাকরিতে নিয়োগে আমার বয়স শেষ হয়ে যাচ্ছে। তবে আমি ফলাফল না পেলেও আমার সংগ্রামে অন্য কেউ সুযোগ পেলে তাও হবে আমার জন্য বড় পাওয়া।’

এর আগে ২০১৭ সালেও প্রথম আলোতে প্রতিবন্ধী বলে তাঁকে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দিচ্ছে না বিজেএসসি (‘আমি কি তবে হেরে যাব?’) শীর্ষক একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল।

২০০৭ সালের জুডিশিয়াল সার্ভিস প্রবেশ পদে নিয়োগ বিষয়ক আদেশের ১০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রাথমিক বাছাই, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার পর কৃতকার্যদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা হবে। সেখানে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা যদি কাউকে শারীরিক বৈকল্য বলে প্রতিবেদন দেন, তবে তিনি নিয়োগের যোগ্য হবেন না। স্বাস্থ্য পরীক্ষার ক্ষেত্রে এই আদেশে চোখের কোনো রোগ বা অস্বাভাবিকতা আছে কি না’ তা পরীক্ষা করানোর কথা বলা আছে। তির্যক দৃষ্টিসম্পন্ন বা চোখের এমন কোনো রোগ বা সমস্যা যা প্রার্থীকে ভবিষ্যতে দায়িত্ব পালনে অক্ষম করে তুলবে সেই প্রার্থীকেও অযোগ্য বলে গণ্য করার কথা বলা হয়েছে। আর কাছের ও দূরের দৃষ্টির জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া মানদণ্ড পূরণ করতে না পারলে তো কথাই নেই।