সন্তান হারানোর ভয় বৃদ্ধার
‘যুদ্ধের সময় আমার স্বামীকে হত্যা করেছে “রাজাকার”রা। লাশও গুম করে ফেলেছে তারা। অনেক খুঁজেও আমি স্বামীর লাশ পাইনি। ছেলেরা এখন বাবার হত্যাকারীর বিচার চায়। শুনেছি পুলিশ সেই ‘রাজাকার’দের দুজনকে ধরেছে। এখন ‘রাজাকার’দের সন্তানেরা আমার ছেলেদের মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। তাই চিন্তায় আছি স্বামীর পর ছেলেদের হারাতে হয় কি না।’
সংবাদ সম্মেলনে ৯০ বছর বয়সী নবিরন নেছা এসব কথা বলেন। পিতা হত্যার বিচারের দাবিতে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করা আনোয়ার হোসেন (নবিরনের ছেলে) নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তার দাবিতে গতকাল বুধবার ওই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে গতকাল বুধবার সকালে ওই সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান মোশাররফ হোসেন। এতে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে নিহত শহীদ আজিবর রহমান মণ্ডলের স্ত্রী নবিরন নেছা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন মামলার বাদী আনোয়ার হোসেন, সাক্ষী মজিবর রহমানের স্ত্রী হাজিরন নেছা, হারেছন নেছা, ইউপির সাবেক সদস্য আলমগীর হোসেন মণ্ডলসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা।
সংবাদ সম্মেলনে নবিরন নেছা বলেন, ‘জীবিত অবস্থায় রাজাকারদের বিচার দেখে যেতে পারলে আমি মরেও শান্তি পাব।’ এ ছাড়া তিনি স্বামী হত্যার বিচার ও ছেলেদের নিরাপত্তার দাবি জানান।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে হলিধানী ইউনিয়নের কোলা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আশির উদ্দীনের পরিবার নির্যাতনের শিকার হয়। তারা আশির উদ্দীনকে হত্যা করতে এসে না পেয়ে ওই পরিবারের তিন সদস্য আজিবর রহমান মণ্ডল, হবিবর রহমান মণ্ডল ও আনসার আলী মণ্ডলকে ধরে নিয়ে গিয়ে ঝিনাইদহ শহরের ধোপাঘাটা সেতুর কাছে নির্দয়ভাবে হত্যা করে। নিহত স্বজনেরা লাশও খুঁজে পাননি। পরদিন তারা মুক্তিযোদ্ধা আশির উদ্দীনের পাঁচটি ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের আরও ২৫টি বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। এ বিষয়ে ২০০৯ সালের ২৫ মার্চ মুক্তিযোদ্ধা আছির উদ্দীন ঝিনাইদহ আদালতে একটি মামলা করেন। কিন্তু তাঁর ওপর চাপ প্রয়োগ করে মামলাটি মিটিয়ে নিতে বাধ্য করান প্রভাবশালী স্বাধীনতাবিরোধীরা। কিন্তু এরই মধ্যে কষ্ট নিয়েই তিনি মারা যান।
শহীদ আজিবরের ছেলে আনোয়ার জানান, চাচা ভাই হত্যার বিচার চেয়ে শেষরক্ষা করতে পারেননি। স্বাধীনতাবিরোধীরা এলাকায় এতটা প্রভাবশালী ছিল যে পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকতে তিনি মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হন।
আনোয়ার আরও জানান, স্বাধীনতাবিরোধীদের ফাঁসি হতে দেখে তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেন। ২০১৫ সালের শেষ দিকে তিনি মামলাটি করেন। দীর্ঘ তদন্ত শেষে গত ২১ অক্টোবর তথ্য–প্রমাণের ভিত্তিতে সদর উপজেলার হলিধানী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান আবদুর রশিদ মিয়া ও সাহেব আলীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আনোয়ার দাবি করেন, চিহ্নিত দুই স্বাধীনতাবিরোধী গ্রেপ্তারের পর তিনিসহ পরিবারের লোকজন নিরাপত্তহীনতায় আছেন। তাঁদের বাড়ির পাশে প্রায়ই অপরিচিত লোকজন ঘোরাফেরা করছে। স্বাধীনতাবিরোধীদের সন্তানেরা দল বেঁধে মোটরসাইকেলে মহড়া দিচ্ছেন। মামলা তুলে নিতে চাপ দেওয়া হচ্ছে। মামলা তুলে না নিলে খুন–জখমের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তাঁরা চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধীদের ফাঁসি ও তাঁদের সন্তানেরা যারা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের ওপর হুমকি দিচ্ছে, তাদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান।
প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে মামলা হওয়ার পর সরেজমিনে তদন্তে আসেন ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তারা। পরে গত ২১ অক্টোবর ইউপি চেয়ারম্যান আবদুর রশিদ মিয়া ও সাহেব আলী নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করেন তাঁরা। এরপর থেকে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারটির ওপর নানা হুমকি অব্যাহত রয়েছে।