প্রসূতিসেবায় ফের সেরা ভৈরব

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর হাত থেকে সেরার স্বীকৃতি সনদ গ্রহণ করছেন বুলবুল আহমেদ। ছবি সংগৃহীত
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর হাত থেকে সেরার স্বীকৃতি সনদ গ্রহণ করছেন বুলবুল আহমেদ। ছবি সংগৃহীত

জীবাণুমুক্তকরণ যন্ত্রটি (অটোক্লেভ) বিকল দীর্ঘদিন। একমাত্র টেবিলটি ভাঙা। জেনারেটর নষ্ট ৫ বছর। জানালার কাচ নেই। এসি থেকে বের হয় না শীতল হাওয়া। ছাদ চুইয়ে পানি গড়ায় মেঝেতে। অস্ত্রোপচার কক্ষের এত সব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও জরুরি প্রসূতিসেবায় সাফল্যের জন্য টানা সাত বছর ধরে ঢাকা বিভাগের সেরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বীকৃতি পেয়ে আসছে ভৈরব। ২০১৮ সালের কার্যক্রম বিবেচনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিশোরগঞ্জের ভৈরব স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে এবারও এই স্বীকৃতি দিয়েছে।

গত সোমবার ঢাকার প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আয়োজিত এক অনুষ্ঠান থেকে স্বীকৃতি সনদ গ্রহণ করেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বুলবুল আহমেদ। সনদ তুলে দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।

হরিপদ দেবনাথ গাইনি সার্জন হিসেবে ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত আছেন ২০০৪ সাল থেকে। ১০ বছর ধরে অবেদনবিদ পদে রয়েছেন সফিউদ্দিন সোহেল। টানা এই স্বীকৃতিতে এই দুজনের আনন্দ যেন কিঞ্চিৎ বেশিই।

এত সীমাবদ্ধতার পরও প্রসূতি নারীদের কাছে হাসপাতালটি কেন ভরসাস্থল হয়ে উঠেছে, প্রশ্নে গাইনি সার্জন হরিপদ দেবনাথ বলেন, ‘সমস্যা অনেক। বলে শেষ করা যাবে না। তবে আমাদের প্রতি প্রসূতি নারীদের বিশ্বাস জন্মেছে, হাসপাতালে পৌঁছাতে পারলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা মিলবেই। এই বিশ্বাসের জোরেই এত কিছু।’ 

হরিপদ দেবনাথ জানান, বর্তমানে হাসপাতালটি থেকে জেলার কুলিয়ারচর ও অষ্টগ্রাম এবং নরসিংদীর বেলাব উপজেলার প্রসূতি নারীরা স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করছেন। একই সঙ্গে উপজেলার আকবরনগর, গোছামারা ও আগানগর কমিউনিটি ক্লিনিকেও স্বাভাবিক প্রসব কার্যক্রম চালু রাখা হয়েছে।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র জানায়, ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৫০ শয্যার। ২০০২ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ‘জরুরি প্রসূতি সেবা’ নামে একটি প্রকল্প চালু করে। হাসপাতালে প্রসূতি নারীদের ২৪ ঘণ্টা সেবা নিশ্চিত করাই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। প্রকল্পের অধীন সিজারিয়ান বিভাগ চালু করা হয়। এ জন্য প্রকল্পের অধীন হাসপাতাল থেকে একজন চিকিৎসককে গাইনি সার্জন ও একজনকে অবেদনবিদ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কিশোরগঞ্জ জেলা থেকে প্রকল্পের অধিভুক্ত করা হয় ভৈরব, করিমগঞ্জ, তাড়াইল ও নিকলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে।

সূত্র জানায়, ভৈরবে ২০০২ সাল থেকে প্রকল্পটি চালু হয়। সে সময় হাসপাতালের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন জহিরুল হক এবং আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ছিলেন মমতাজুল হক। মমতাজুল প্রকল্পের অধীনে অবেদনবিদের প্রশিক্ষণ নেন। গাইনি সার্জন হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় হাসপাতালের চিকিৎসক সালমা সিদ্দিকাকে। বিশেষ করে মমতাজুলের প্রচেষ্টায় ভৈরবে শুরু থেকে কার্যক্রমটি গতি পায়। কয়েক বছরের ব্যবধানে ভৈরব ছাড়া অধিভুক্ত বাকি তিনটি উপজেলায় কার্যক্রমটি বন্ধ হয়ে যায়।

একই সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে জরুরি প্রসূতিসেবা গ্রহণ করেছেন ৪ হাজার ৫৯৪ জন নারী। এর মধ্যে হাসপাতালে এসে সন্তান প্রসব করেছেন ১ হাজার ৬৪৩ জন। তাঁদের মধ্যে স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে ৮৫৪ এবং অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রসব হয়েছে ৭৭২ জন নারীর। গত বছর কোনো মাতৃমৃত্যু ছিল না। তবে একজন নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে।

স্বাস্থ্য খাতে এই ইতিবাচক পরিসংখ্যানের কারণে ভৈরব হাসপাতালকে এবার ঢাকা বিভাগের প্রথম ঘোষণা দেওয়া হয়। আর প্রথম স্বীকৃতি আসে ২০১২ সালে। এরপর মাঝে আর বিরতি নেই।

সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় থাকায় বেশ খুশি ভৈরবে প্রকল্পের সূচনা করা মমতাজুল হক। তিনি দুই বছর আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পের পরিচালক ও লাইন ডাইরেক্টর পদ থেকে অবসরে গেছেন। মমতাজুল বলেন, ভৈরবে প্রকল্পটি সচল থাকায় আশপাশের কয়েকটি উপজেলার গরিব ও অসহায় নারীদের প্রসূতি স্বাস্থ্যসেবা পেতে এখন আর কষ্ট হচ্ছে না। এতে করে সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরেছে সরকারি স্বাস্থ্যসেবায়।

গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালটি ১০০ শয্যায় উন্নীতকরণের অবকাঠামোগত উন্নয়ন চলছে। এ কারণে অস্ত্রোপচার কক্ষের ভেতর ও বাইরের পরিবেশ নোংরা। অটোক্লেভ বিকল থাকায় কেরোসিনের চুলা জ্বালিয়ে যন্ত্র জীবাণুমুক্ত করা হচ্ছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বুলবুল আহমেদ বলেন, ‘এ নিয়ে সাতবার হলো। এই সাফল্য ধরে রাখতে আমরা আরও দায়িত্বশীল ও সচেতন থাকব। তবে সমস্যা হলো, চাহিদার সঙ্গে জোগানের পার্থক্য রয়েছে। দুইয়ের দূরত্ব কমে এলে আরও ভালো কিছু করতে কোনো সমস্যা হবে না।’