বুলবুলে লন্ডভন্ড খুলনা, ভেঙে পড়েছে বিদ্যুৎব্যবস্থা

বুলবুলের তাণ্ডবে গাছ ভেঙে পড়েছে ঘরের ওপর। খুলনা, ১১ নভেম্বর। ছবি: শেখ আল এহসান
বুলবুলের তাণ্ডবে গাছ ভেঙে পড়েছে ঘরের ওপর। খুলনা, ১১ নভেম্বর। ছবি: শেখ আল এহসান

চারদিকে ভেঙে পড়ে আছে বড় বড় গাছ। কোথাও থেকে টিনের চালা উড়ে এসে পড়ে আছে বিলের মধ্যে। ছোট ছোট কাঁচা ঘর মিশে আছে মাটিতে। এমন দৃশ্য এখন খুলনার কয়রা উপজেলার প্রায় প্রতিটি এলাকায়। ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ কেড়ে নিয়েছে অনেকের শেষ সম্বলটুকুও।

খুলনা আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আমিরুল আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, সুন্দরবন অতিক্রম করে ভোর পাঁচটার দিকে খুলনার কয়রা ও দাকোপ উপজেলায় আঘাত হানে বুলবুল। আঘাত হানার সময় বাতাসের ঘণ্টায় গতিবেগ ছিল ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার। পরে খুলনা শহরের দিকে ঢুকতে ঢুকতে গতিবেগ কমতে শুরু করে। শেষের দিকে ঝড়ের গতিবেগ ছিল ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার। পরে তা দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে সরে গিয়ে সাতক্ষীরার ওপর দিয়ে চলে যায়। যেহেতু ঝড়ের মূল আঘাত ছিল কয়রা ও দাকোপ উপজেলায়, এ কারণে ওই দুই উপজেলায় ক্ষতির পরিমাণ তুলনামূলক বেশি হতে পারে।

খুলনার সর্বদক্ষিণের সর্বশেষ জনপদ কয়রা। চারপাশে বড় বড় নদী দিয়ে ঘেরা ওই জনপদের পরই সুন্দরবন। এই উপজেলার অন্তত ২৫ জন মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতকাল শনিবার সকাল থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষ না গেলেও সন্ধ্যার দিকে সবকিছু ফেলে মানুষ ছুটে যায় সেখানে। সারা রাত গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির পর রাত তিনটার দিকে বইতে শুরু করে ঝোড়ো হাওয়া। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে বাতাসের গতিবেগও। আজ রোববার ভোর পাঁচটার দিকে শুরু হয় বাতাসের তাণ্ডব। একটানা চলে প্রায় সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত। ঝড়ের তাণ্ডবে কেউ আর বের হতে পারেনি। সকাল ১০টার দিকে বাতাসের গতি কমে এলে মানুষ বের হয়ে দেখতে পায় ঝড়ের ভয়াবহতা। লন্ডভন্ড হয়ে পড়ে আছে পুরো কয়রা উপজেলা।

ঝড়ের আঘাতে গাছে ভেঙে বন্ধ হয়ে গেছে সড়ক। খুলনা, ১১ নভেম্বর। ছবি: শেখ আল এহসান
ঝড়ের আঘাতে গাছে ভেঙে বন্ধ হয়ে গেছে সড়ক। খুলনা, ১১ নভেম্বর। ছবি: শেখ আল এহসান

কয়রা উপজেলা নিয়ন্ত্রণকক্ষে দায়িত্বরত উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. জাফর রানা প্রথম আলোকে বলেন, পুরো কয়রা যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গাছপালা। এই সংখ্যা গণনারও বাইরে। এ ছাড়া দুই হাজারের মতো ঘরবাড়ি আংশিক ও সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে প্রায় সব মাছের ঘের। কোনো মাছের ঘেরকে আলাদা করে চিহ্নিত করার উপায় নেই। এ ছাড়া বিদ্যুৎব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছে। কোথাও কোথাও গাছ পড়ে তার কেটে গেছে। অনেক জায়গায় বিদ্যুতের খুঁটিও ভেঙে পড়েছে। সব মিলিয়ে কয়রা উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

কয়রার মতো না হলেও একই অবস্থা বিরাজ করছে দাকোপ উপজেলায়ও। ওই উপজেলায় গাছচাপায় মারা গেছেন প্রমিলা মণ্ডল (৫২) নামের এক নারী।

এই উপজেলার নিয়ন্ত্রণকক্ষের দায়িত্বরত উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা শেখ আবদুল কাদের বলেন, উপজেলার ১ হাজার ৭৬৫টি ঘরবাড়ি আংশিক ও সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৩১৫টি চিংড়িঘের ও ৪২৫টি পুকুর বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য গাছ ভেঙে পড়েছে।

খুলনা নগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে তাণ্ডবের চিত্র। বিভিন্ন জায়গায় পড়ে আছে গাছ। কাটা পড়েছে বিদ্যুতের তারও। বেশির ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দোকানের বিলবোর্ড।

বুলবুলের আঘাতে খুলনার কয়রা ও দাকোপে উপজেলার বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খুলনা, ১১ নভেম্বর। ছবি: শেখ আল এহসান
বুলবুলের আঘাতে খুলনার কয়রা ও দাকোপে উপজেলার বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খুলনা, ১১ নভেম্বর। ছবি: শেখ আল এহসান

খুলনা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আজিজুল হক জোয়ার্দ্দার প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কয়রা ও দাকোপ উপজেলা। অন্য উপজেলাগুলোতেও কমবেশি ঘর ও গাছপালা ভেঙে পড়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করতে সব উপজেলা নির্বাহীদের নেতৃত্বে একটি করে টিম গঠন করা হয়েছে। কাল সোমবার নাগাদ পুরো জেলার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে।

বিপর্যস্ত বিদ্যুৎব্যবস্থা
গতকাল বিকেল থেকেই বিদ্যুৎ নেই খুলনার কোনো উপজেলাতেই। আর খুলনা নগরে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মধ্যরাত থেকে। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎহীন আছে পুরো খুলনা।

খুলনা নগরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি। ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান প্রকৌশলী হাছান আলী তালুকদার বলেন, পরিস্থিতি খারাপ দেখেই বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। ঝড় থেমে যাওয়ার পর দেখা যায়, খুলনা নগরের মধ্যেই বিভিন্ন জায়গায় ৩৩ হাজার ভোল্টের মূল বিদ্যুতের তারের ওপর বড় বড় গাছ উপড়ে পড়েছে। অনেক এলাকায় তার কেটে পড়েছে। ঝড়ের পর থেকেই গাছ অপসারণ করে লাইন সচলের চেষ্টা করা হচ্ছে। আশা করা যায়, বিকেল নাগাদ খুলনা নগরে বিদ্যুৎ–সংযোগ দেওয়া সম্ভব হবে।

খুলনার অন্যান্য উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে খুলনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। ওই সমিতির কর্মকর্তারা বলেন, ঝড়ে পুরো বিদ্যুৎব্যবস্থাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় মূল তারের ওপর পড়ে আছে গাছ। তা ছাড়া অনেক জায়গায় বৈদ্যুতিক খুঁটিও মাটিতে নুইয়ে পড়েছে। সব মিলিয়ে কবে নাগাদ ওই বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে, তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না তাঁরা।