প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান, জাপা মহাসচিবকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান নূর হোসেনের মা'র

জাপা মহাসচিবের বক্তব্যের প্রতিবাদে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান নিয়েছে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের শহীদ নূর হোসেনের পরিবারের সদস্যরা। ঢাকা, ১১ নভেম্বর। ছবি: আহমেদ দীপ্ত
জাপা মহাসচিবের বক্তব্যের প্রতিবাদে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান নিয়েছে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের শহীদ নূর হোসেনের পরিবারের সদস্যরা। ঢাকা, ১১ নভেম্বর। ছবি: আহমেদ দীপ্ত

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শহীদ নূর হোসেন ‘মাদকাসক্ত’ ছিলেন বলে মন্তব্য করেছিলেন জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিব মসিউর রহমান (রাঙ্গা)। এই বক্তব্যের প্রতিবাদে আজ সোমবার বিকেল চারটা থেকে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান নিয়েছেন নূর হোসেনের মাসহ পরিবারের সদস্যরা। তাঁরা বলছেন, মসিউর রহমান তাঁর বক্তব্যের জন্য ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত তাঁরা অবস্থান চালিয়ে যাবেন।

বিকেল চারটার কিছু আগে নূর হোসেনের পরিবারের সদস্যরা তাঁদের প্রতিবাদী অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন। প্রেসক্লাবের মূল ফটকের পশ্চিম পাশের ফুটপাথে তাঁরা বসে আছেন।

শহীদ নূর হোসেনের মা মরিয়ম বিবি, তিন ভাই, এক বোনসহ পরিবারের প্রায় ১২ সদস্য এই অবস্থানে অংশ নিচ্ছেন। নূর হোসেনের মা মরিয়ম বিবি কিছুক্ষণ পরপর চোখ মুছছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছেলে একটা সিগারেট পর্যন্ত খেত না। তাহলে মসিউর রহমান রাঙ্গা কোন বিবেকে এই কথা বলল? তিনি কি এসে দেখেছেন, আমার ছেলে দেশের জন্য শহীদ হইছে। ও জনগণের জন্য রাজপথে নেমেছিল, বড়লোক হওয়ার জন্য না।’

মরিয়ম বিবি বলেন, ‘আমি জনগণের কাছে বিচার চাই। তাঁকে (মসিউর রহমান) ক্ষমা চাইতে হবে। তা না হওয়া পর্যন্ত আমি বুড়ো মানুষ, কষ্ট হলেও এইখানে বসে থাকব। নূর হোসেন হত্যারও বিচার হয় নাই। সেই বিচারও আমি চাই। রাঙ্গা তো মন্ত্রী ছিল, সে কোন জ্ঞানে এমন কথা বলল?’

গতকাল রোববার জাতীয় পার্টির মহানগর উত্তর শাখার উদ্যোগে গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় শহীদ নূর হোসেন মাদকাসক্ত ছিলেন বলে মন্তব্য করেন মসিউর রহমান। জাপার বনানীর কার্যালয়ে ওই আলোচনা সভা হয়।

মসিউর রহমান ওই অনুষ্ঠানে বলেন, ‘হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কাকে হত্যা করলেন। নূর হোসেনকে? নূর হোসেন কে? একটা অ্যাডিকটেড ছেলে। একটা ইয়াবাখোর, ফেনসিডিলখোর।’ তাঁর দাবি, নূর হোসেনের হত্যার ঘটনায় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ বা তাঁর সরকার দায়ী ছিল না। যে ধরনের গুলিতে নূর হোসেন মারা গেছেন, সে ধরনের গুলি তখন পুলিশ ব্যবহার করত না।

এমন বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে ক্ষুব্ধ শহীদ নূর হোসেনের পরিবারের সদস্যরা। নূর হোসেনের বড় ভাই আলী হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘৩৩ বছর ধরে নূর হোসেনকে সম্মান দিচ্ছে এই জাতি। তাঁকে গণতন্ত্রের প্রতীক বলে জনগণ। শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে গণতন্ত্র দিবসও পালন করা হয়। সে গণতন্ত্রের জন্য মারা গেল। এখন তাঁরই সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ কথা বলা কেমন কথা হলো? আমাদের রাস্তায় নামতে হলো কেন? গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যারা মারা গেছে তাদের অবমাননা হলো। শহীদ পরিবারের অবমাননা হলো। নূর হোসেন হত্যাকাণ্ডের জন্য স্বৈরাচার এরশাদ সংসদে বসে মাফ চেয়েছিল, আমার বাবার কাছে মাফ চেয়েছিল। ১৯৯৬ সাল থেকে শুরু হলো শহীদ নূর হোসেন গণতন্ত্র দিবস। প্রতিবছর ১০ নভেম্বর তা পালন করা হয়। এই সময়েই কেন এ বক্তব্য তিনি (মসিউর রহমান) দিলেন। জনগণের কাছে আমাদের দাবি, এই লোকের বিচার হোক। এই লোকের নাম মুখে নিতেও কষ্ট হচ্ছে।’ তখন কি ফেনসিডিলের ব্যবহার ছিল, ইয়াবার ব্যবহার ছিল? প্রশ্ন আলী হোসেনের।

নূর হোসেনের পরিবারের সদস্যরা জানান, জাপা মহাসচিব তাঁর বক্তব্য তুলে নিয়ে ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত তাঁরা প্রেসক্লাবের সামন থেকে সরে যাবেন না।

প্রতিবছর ১০ নভেম্বর ‘শহীদ নূর হোসেন দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। ১৯৮৭ সালের এই দিনে তৎকালীন স্বৈরশাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বুকে-পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’, ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’—স্লোগান ধারণ করে মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন নূর হোসেন। মিছিলটি গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টে পৌঁছানোর পর এর পুরোভাগে থাকা নূর হোসেন গুলিবিদ্ধ হন। তাঁর তাজা রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ, বেগবান হয় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতন ঘটে।