উদয়নের বগিতে ঢুকে যায় তূর্ণা নিশীথা, নিহত ১৬

ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশনে গতকাল সোমবার রাত তিনটার দিকে বড় ধরনের দুর্ঘটনায় পড়ে দুটি ট্রেন। রেলওয়ে স্টেশন ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছে, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী আন্তনগর তূর্ণা নিশীথা সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী আন্তনগর উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনের মাঝামাঝি বগিতে ঢুকে পড়লে এ দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনায় ১৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন বলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক হায়াত উদ দৌলা খান জানিয়েছেন।

রেলওয়ে স্টেশন, প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, তূর্ণা নিশীথা গতকাল রাত ২টা ৪৮ মিনিটে শশীদল রেলওয়ে স্টেশন অতিক্রম করে মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশনের দিকে যাত্রা করে। ট্রেনটিকে আউটারে থামার জন্য সংকেত দেওয়া হয়। আর উদয়ন এক্সপ্রেস কসবা রেলওয়ে স্টেশন ছেড়ে মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশনে প্রবেশ করার পথে ট্রেনটিকে মেইন লাইন ছেড়ে ১ নম্বর লাইনে আসার সংকেত দেওয়া হয়। উদয়নের ছয়টি বগি প্রধান লাইনে থাকতেই তূর্ণা নিশীথার চালক সিগন্যাল অমান্য করে ট্রেনটির মাঝামাঝি ঢুকে পড়ে। এতে উদয়নের তিনটি বগি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। পরে তূর্ণা নিশীথা ট্রেনটির চালক তাছের উদ্দিন ইঞ্জিন চালু রেখে পালিয়ে যান।

মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশনের মাস্টার মো. জাকের হোসেন চৌধুরী বলেন, তূর্ণা নিশীথা সিগন্যাল অমান্য করায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক হায়াত উদ দৌলা খান বলেন, এই দুর্ঘটনায় ১৬ জন মারা গেছেন। নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিরা হলেন চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম রাজারগাঁও গ্রামের মুজিবুর রহমান (৫৫) ও তাঁর স্ত্রী কুলসুম (৪০), সদর উপজেলার উত্তর বালিয়া গ্রামের বিল্লাল মিয়াজির মেয়ে ফারজানা আক্তার (১৫), হাইমচর উপজেলার দক্ষিণ ঈশানপুর গ্রামের মইন উদ্দিনের স্ত্রী কাকলী আক্তার (২০) ও মরিয়ম বেগম (৬); হবিগঞ্জের সৈয়দাবাদ এলাকার আজমত উল্লাহের ছেলে রিপন মিয়া (২৫), সদর উপজেলার বাহুলা গ্রামের ইয়াছিন আরাফাত (১২), চুনারুঘাট উপজেলার তীরেরগাঁও গ্রামের সুজন আহাম্মেদ (২৪), বানিয়াচং উপজেলার মদনমুরক গ্রামের মো. আল-আমিন (৩০), হবিগঞ্জ পৌরসভার আনোয়ারপুর এলাকার বাসিন্দা ও হবিগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি আলী মোহাম্মদ ইউসুফ (৩২), বানিয়াচং উপজেলার বড়বাজারের মো. সোহেলের মেয়ে আদিবা (২), চুনারুঘাট উপজেলার আহমাদাবাদ গ্রামের আবদুল ছালামের স্ত্রী পিয়ারা বেগম (৪১); মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার গাজীপুর গ্রামের জাহেদা খাতুন (৩০), ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের সোহেল রানার মেয়ে সোহামনি (৩), নোয়াখালীর মাইজদীর শংকর হরিজনের ছেলে রবি হরিজন (২৩) এবং অজ্ঞাত ৪১ বছর বয়সী এক নারী।

এই দুর্ঘটনায় শতাধিক যাত্রী আহত হয়েছেন। আহত ব্যক্তিদের কসবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতাল ও কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।

ট্রেন দুর্ঘটনায় উদ্ধার কাজ শুরু করে কসবা, আখাউড়া ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট, কসবা থানা, আখাউড়া রেলওয়ে পুলিশ, বিজিবি। ভোর সাড়ে ৫টায় উদয়ন ট্রেনের ছয়টি বগি ফেলে দিয়ে ট্রেনটি মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশন ছেড়ে যায়। আখাউড়া ও লাকসাম রেলজংশন থেকে দুটি রিলিফ ট্রেন দুর্ঘটনা কবলিত ট্রেন দুটি উদ্ধারে কাজ করে। ৮ ঘণ্টা পর আজ দুপুরে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট পথে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়।

খবর পেয়ে রাত সাড়ে তিনটার দিকে কসবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাসুদ উল আলম ঘটনাস্থলে যান। রাতেই ঘটনাস্থলে যান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক হায়াত উদ দৌল্লা খান ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আনিসুর রহমান।

উদ্ধার তৎপরতা শেষে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন কসবা উপজেলার বায়েক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মরদেহ নিয়ে যান। সেখানে একটি অস্থায়ী তথ্যকেন্দ্র খোলা হয়। সেখানে বিনা ময়নাতদন্তে লাশ পরিবারের সদস্যদের কাছে প্রশাসনের উপস্থিতিতে হস্তান্তর করা হয়। লাশ নিতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনেরা।

দুর্ঘটনার খবর পেয়ে রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মোফাজ্জল হোসেন ও রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. সামসুজ্জামান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এরপর তাঁরা অস্থায়ী তথ্যকেন্দ্রে যান। সেখানে তাঁরা নিহতদের স্বজনদের সান্ত্বনা দেন। এ সময় রেলপথমন্ত্রী ঘোষণা দেন, নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে এক লাখ টাকা করে দেওয়া হবে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে লাশ দাফনের জন্য নগদ ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। রেলমন্ত্রী বলেন, তূর্ণা নিশীথা ট্রেনের চালক, সহকারী চালক ও ট্রেনের গার্ড আবদুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

এ দুর্ঘটনায় রেল মন্ত্রণালয়, রেলভবন ও বিভাগীয় রেলওয়ে কার্যালয় চারটি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসন একটিসহ মোট পাঁচটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তদন্ত কমিটিগুলোকে তিন কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের সচিব মোফাজ্জল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, রেলভবন চট্টগ্রাম রেলওয়ের প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী মিজানুর রহমানকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই তদন্ত কমিটির অন্য তিন সদস্য হলেন চিফ সিগন্যাল অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার অসিত কুমার তালুকদার, চট্টগ্রাম রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশল সুবক্ত গীণ ও সিওপিএস নাজমুল ইসলাম।

এদিকে বিভাগীয় রেলওয়ে কার্যালয় চট্টগ্রামের ডিটিও নাসির উদ্দিনকে প্রধান করে আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। এই কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন চট্টগ্রাম রেলওয়ের ডিএমই ফয়েজ আহমেদ, ডিএফটিই জাহেদ আরেফিন পাটোয়ারি ও ডিইএন হামিদুল ইসলাম। ব্রাহ্মণবাড়িয়া অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মিতু মরিয়মকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক হায়াত উদ দৌলা খাঁন প্রথম আলোকে বলেন, রেল দুর্ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা ও আহতদের পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে।

পুলিশ সুপার মুহাম্মদ আনিসুর রহমান বলেন, রেল দুর্ঘটনায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক আনতে রাত তিনটা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা, কসবা, আখাউড়া থানা পুলিশ কাজ করেছে।