ভিন্ন মতের নির্মম 'শাস্তি' পেয়েছিলেন আবরার

‘আবরার হত্যাকাণ্ড’ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) জন্য স্পষ্টতই একটি কলঙ্কিত অধ্যায়, তা এখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রিয় বিদ্যাপীঠে নিজের হলে আবরারকে হত্যার শিকার হতে হয়েছে অন্য সহপাঠীদের হাতে। আর এ হত্যার ঘটনার মাধ্যমে বের হয়ে এসেছে বুয়েটের মতো শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের নির্যাতনের এক বীভৎস অধ্যায়।

আবরার ফাহাদ। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
আবরার ফাহাদ। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

গত ৭ অক্টোবর সকালে প্রথম আলো অনলাইনে এক প্রতিবেদক ফোন করে জানান, গতকাল দিবাগত রাত ৩টার দিকে বুয়েটের শেরে বাংলা হল থেকে আবরার ফাহাদ (২১) নামে এক ছাত্রের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি জানান, এটি হত্যা না আত্মহত্যা, তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ওই সংবাদের ভিত্তিতে অনলাইনে নিউজ করা হলো ‘বুয়েট ছাত্রের রহস্যজনক মৃত্যু’। তখনো বোঝা যায়নি ঘটনাটি কতটা বীভৎস।

এর কিছুক্ষণ পরে জানা গেল, শিবির সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে ছেলেটিকে। ছেলেটির শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন। শরীরের ভেতরে রক্তগুলো জমাট বেঁধে কালো হয়ে গিয়েছিল। সময় যত গড়াতে লাগল, ততই নৃশংস এক হত্যাকাণ্ডের মুখোশ উন্মোচিত হতে লাগল। রহস্যজনক সেই মৃত্যুর জের ধরে এমন এক খুনের বর্ণনা সামনে এল, যার বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠল গোটা দেশ। জানা গেল, নিজের হলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হাতে খুন হয়েছেন আবরার।

বুয়েটের এমন ঘটনা ঘটতে পারে—এ যেন সাধারণ মানুষের কল্পনার বাইরে, এ যেন দুঃস্বপ্ন। যে মা সকালবেলা ঘুম থেকে উঠিয়ে ছেলেকে ঢাকায় পড়তে পাঠিয়েছিলেন, সেই মাকেই পরদিন অপেক্ষা করতে হয় ছেলের লাশের জন্য। এ ঘটনা কাঁদায় পুরো জাতিকে।

৬ অক্টোবর সকাল ৯টায় আবরারকে ঢাকার বাসে তুলে দিয়েছিলেন মা। ছেলের সঙ্গে এটাই তাঁর শেষ দেখা। ছুটিতে কুষ্টিয়ায় পরিবারের কাছে এসেছিল আবরার। ছুটি তখনো কিছুদিন বাকি ছিল, তবে বরাবরই ভালো ছাত্র আবরার পড়াশোনার জন্য একটু আগেভাগেই ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। রাস্তায় বহুবার মায়ের ফোন পেয়েছিলেন তিনি। উদ্বিগ্ন মা জানতে চেয়েছেন, পৌঁছাতে আর কত দূর? বিকেল ৫টায় বুয়েটের শেরে বাংলা হলে পৌঁছান আবরার। সন্ধ্যা থেকে নিজের রুমে বসে পড়ছিলেন। ফেরার পথে মা রান্না করে দিয়েছিলেন। রাতে সেটা খাবেন বলেই ঠিক করে নিয়েছিলেন। রাত ৮টায় তাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় হলের বড় ভাইদের কক্ষে। এরপর রাতে অনেকবার আবরারকে ফোন দেন মা। মুঠোফোনটা কেবল বেজেই গিয়েছিল, কেউ ধরেনি।

আবরার ফাহাদ
আবরার ফাহাদ, বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের (১৭ তম ব্যাচ) শিক্ষার্থী। মেধাবী ছাত্র আবরার উচ্চ মাধ্যমিকের পরে দেশের শীর্ষ তিন বিদ্যাপীঠ বুয়েট, মেডিকেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তবে প্রকৌশলী হওয়ার ইচ্ছে থেকে ভর্তি হন বুয়েটে। কুষ্টিয়ার পিটিআই সড়কে তাঁদের বাড়ি। বাবা বরকত উল্লাহ বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের নিরীক্ষক কর্মকর্তা ছিলেন। মা রোকেয়া খাতুন একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষক। দুই ভাইয়ের মধ্যে আবরার ফাহাদ বড়। ছোট ভাই আবরার ফায়াজ ঢাকা কলেজের উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল। সেও ঢাকা কলেজের হোস্টেলে থাকত। অক্টোবরে ছুটিতে দুই ভাই একসঙ্গে কুষ্টিয়া গিয়েছিল। পড়ার জন্য আবরার আগেই ফিরে আসেন হলে। তিনি শেরেবাংলা হলের নিচতলায় ১০১১ নম্বর কক্ষে থাকতেন।

আবরারকে হত্যার পরিকল্পনা
ছুটিতে বাড়িতে বসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বেশ সক্রিয় ছিলেন আবরার। স্ট্যাটাসও দিচ্ছিলেন। ওদিকে ঢাকায় বসে শিবির সন্দেহে তাকে মারধর করে হল ছাড়া করার পরিকল্পনা করেছিলেন বুয়েট ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। নিজেদের মধ্যে একটি মেসেঞ্জারে গ্রুপ রয়েছে তাদের। সেখানেই চলছিল কথার আদান-প্রদান। এদের মধ্যে ছিলেন, বুয়েট ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান ওরফে রবীন, মনিরুজ্জামান মনির।

৫ অক্টোবর দুপুর ১২টা ৪৭ মিনিটে এই গ্রুপে লেখেন মেহেদী হাসান। তিনি লেখেন— ‘১৭-র আবরার ফাহাদ। মেরে হল থেকে বের করে দিবি দ্রুত। এর আগেও বলেছিলাম। তোদের তো দেখি কোনো বিকার নেই। শিবির চেক দিতে বলেছিলাম।’

মেহেদী হাসান এই কথা লেখার পর মনিরুজ্জামান লেখেন, ‘ওকে ভাই।’

তখন মেহেদী আবার লেখেন, ‘দুই দিন টাইম দিলাম।’

মনিরুজ্জামান আবার লেখেন, ‘ওকে ভাই।’

মেহেদী লেখেন, ‘দরকারে ১৬ ব্যাচের মিজানের সঙ্গে কথা বলিস। ও আরও কিছু ইনফরমেশন দেবে শিবির ইনভলভমেন্টের বিষয়ে।’

এর পরদিন বিকেলে (৬ অক্টোবর) হলে নিজের ১০১১ কক্ষে ফিরে আসেন আবরার। আবরারের ফিরে আসার খবরে আবারও কথাবার্তা শুরু হয় ওই মেসেঞ্জার গ্রুপের সদস্যদের। এবার যোগ দেন শাহীন, শওকত, আবু নওশাদ সাকিব, শামসুল।

ওদিন সন্ধ্যা ৭টা ৫২ মিনিটে মনিরুজ্জামান মনির মেসেঞ্জারে ওই গ্রুপে লেখেন, ‘নিচে নাম সবাই।’

এরপর শাহীন (পুরো পরিচয় জানা যায়নি) লেখেন, ‘ওকে ভাই।’

শওকত (পুরো পরিচয় জানা যায়নি) লেখেন, ‘ওকে ভাই।’

মেসেঞ্জারে আবু নওশাদ সাকিব (পুরো পরিচয় জানা যায়নি) নামের বুয়েট ছাত্র লেখেন, ‘আবরার ফাহাদ কী হলে আছে?’

জবাবে শামসুল লেখেন, ‘হ ভাই। ২০১১ তে’। তখন নওশাদ লেখেন, ‘২০১১ তে আছে।’

আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের একদল নেতা–কর্মী। প্রথম আলো ফাইল ছবি
আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের একদল নেতা–কর্মী। প্রথম আলো ফাইল ছবি

নিজের কক্ষ থেকে ২০১১ তে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় আবরারকে। এরপরই তাঁকে পেটানো হয়। পরবর্তীতে এ হত্যায় গ্রেপ্তার আসামিরা জানান কীভাবে তাঁরা আবরারকে হত্যা করেন। সে বিষয়ে আমরা পরে আসব।

মেসেঞ্জার গ্রুপটি রাত ১টা ২৬ মিনিটে আবার সক্রিয় হয়। এবার এতে যোগ দেন ইফতি মোশাররফসহ কয়েকজন।

একজন (নাম পড়া যায়নি) লেখেন, ‘আবরার ফাহাদকে ধরছিলি তোরা?’

জবাবে ইফতি মোশাররফ (আবরারকে হত্যা মামলায় আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন) ফেসবুক মেসেঞ্জারে লেখেন, ‘হ।’

এরপর একজন (নাম পড়া যায়নি) লেখেন, ‘বের করসস।’

জবাবে মোশাররফ লেখেন, ‘কী? হল থেকে নাকি স্বীকারোক্তি?’

একজন (নাম পড়া যায়নি) লেখেন, ‘স্বীকার করলে তো বের করে দেওয়া উচিত।’

জবাবে ইফতি মোশাররফ লেখেন, ‘মরে যাচ্ছে। মাইর বেশি হয়ে গেছে।’

সেই রাতে প্রত্যক্ষদর্শীরা যা দেখেছিলেন
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসি বাংলাকে ওই দিন যা দেখেছিলেন তা জানান আবরারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ একজন। তিনি বলেন, ‘৬ অক্টোবর দিবাগত রাত ১টার দিকে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে আবরারের কক্ষ ১০১১ নম্বর রুমে গিয়ে দেখি সে সেখানে নেই। পরে জানতে পারি রাত সোয়া আটটার দিকে তাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল ছাত্রলীগের ছেলেরা, এটা ক্যাম্পাসের নৈমিত্তিক ঘটনা। তাই এ ব্যাপারে ততটা গুরুত্ব দিইনি’।

তবে রাত ৩টার দিকে তিনি জানতে পারেন আবরারকে হত্যা করে একতলা এবং দোতলার সিঁড়ির মাঝামাঝি ফেলে রাখা হয়েছে। কী ঘটেছে কয়েকজনের কাছে জানতে চান। জানতে পারেন, আবরারকে দুই-দফা দুটি রুমে নিয়ে গিয়ে পেটানো হয়েছে। প্রথমে ২০১১ নম্বর রুমে, পরে ২০০৫ নম্বর রুমে।

ওই ছাত্র বলেন, ‘সেই সময় ঘটনাস্থলে যাই। দেখি বুয়েট মেডিকেলের ডাক্তার এসেছেন এবং আবরারকে দেখে মৃত বলে ঘোষণা করছেন। সিঁড়ির কাছের জায়গাটি ঘিরে রেখেছে ছাত্রলীগের ছেলেরা। সাধারণ ছাত্রদের সেখানে জড়ো হতে বাধা দিচ্ছিল তারা। আমরা তখন হলের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রভোস্টকে বলি, স্যার আপনার সঙ্গে কথা আছে। স্যারকে নিয়ে ১০১১ রুমে আসি এবং দরজা বন্ধ করে স্যারকে বলি, স্যার এখানে কিছু হচ্ছে, যেটা স্বাভাবিক না। স্যার আমাদের তখন বলেন, তোমরা নিজেরা একত্র হও। এর মধ্যে ছাত্রলীগের ছেলেরা খবর পেয়ে আমাদের দরজা বাইরে থেকে ধাক্কা দিতে থাকে। তারা ভোর ৫টা পর্যন্ত সেখানেই ছিল। তারপর তারা চলে গেলে আমরা ফেসবুকে আমাদের বুয়েটের সব হলের ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং একত্র হতে থাকি।’

সাক্ষী ভিডিও ফুটেজ
আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার পরদিনই আন্দোলনে নামে বুয়েট শিক্ষার্থীরা। সেই সঙ্গে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করেন। বুয়েটের হলে সিসিটিভি ক্যামেরা থাকায় ঘটনার ফুটেজ সংগ্রহে নামে শিক্ষার্থীরা। ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার একটি ভিডিও ফুটেজ পাওয়া যায় হল প্রশাসন থেকে। তবে ঘটনার পুরো ভিডিওর দাবিতে প্রাধ্যক্ষকে অবরুদ্ধ করেন শিক্ষার্থীরা। পরে তাদের দাবির মুখে পুরো ভিডিও তুলে দেওয়া হয়।

সেই ভিডিওতে দেখা যায়, আবরারকে মারধরের পর কক্ষ থেকে বের করা হয়। প্রথমে একজনকে বারান্দা দিয়ে কিছুটা দৌড়ে এসে দাঁড়াতে দেখা যায়। এরপর তিনি একই পথে ফিরে যান। কিছুক্ষণ পর আবরারকে তিনজন ধরাধরি করে নিয়ে আসেন। তাঁদের পেছনে একজনকে হেঁটে আসতে দেখা যায়, তাঁর পেছনে আরেকজন হেঁটে আসেন। এর পরপরই আরও পাঁচজনকে ওই বারান্দা দিয়ে হেঁটে আসতে দেখা যায়।

ভিডিও ফুটেজ অনুযায়ী ওই দিন রাতে আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত সন্দেহে ১৯ জনের বিরুদ্ধে চকবাজার থানায় মামলা দায়ের করেন।

মামলার এজাহারভুক্ত আসামিরা প্রত্যকেই বুয়েটের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা হলেন মেহেদী হাসান, সিই বিভাগ (কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ১৩তম ব্যাচ), মুহতাসিম ফুয়াদ (১৪তম ব্যাচ, সিই বিভাগ), অনীক সরকার (১৫তম ব্যাচ), মেহেদী হাসান রবিন (কেমিক্যাল বিভাগ, ১৫তম ব্যাচ), ইফতি মোশারফ হোসেন (বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ), মনিরুজ্জামান মনির (পানিসম্পদ বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাজ, মাজেদুল ইসলাম (এমএমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মোজাহিদুল (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), তানভীর আহম্মেদ (এমই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), হোসেন মোহাম্মদ তোহা (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), জিসান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), আকাশ (সিই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), শামীম বিল্লাহ (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), শাদাত (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), তানীম (সিই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মোর্শেদ (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মোয়াজ, মনতাসির আল জেমি (এমআই বিভাগ)।

আসামির ভয়ংকর বর্ণনায় সেই রাতের কথা
আবরার হত্যায় ৭ তারিখ সকালে দুজনকে আটক করে পুলিশ। পরে রাতে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বুয়েটের শেরে বাংলা হলে অভিযান চালিয়ে এবং সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। ১০ তারিখ আদালতে প্রথম স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সমাজসেবাবিষয়ক উপসম্পাদক ইফতি মোশাররফ ওরফে সকাল। তাঁর কক্ষেই ৬ অক্টোবর রাতে শিবিরকর্মী সন্দেহে পেটানো হয় আবরারকে। মূলত এই স্বীকারোক্তি থেকেই বের হয়ে আসে হত্যাকাণ্ডের এক ভয়াবহ বর্ণনা।

ঘটনার বিবরণে ইফতি জানান, ৬ অক্টোবর রাত আটটার কিছু পর আবরারকে ২০১১ নম্বর কক্ষে নিয়ে আসা হয়। আবরারের দুটি মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপও সঙ্গে আনা হয়। তাঁর রুমমেট বুয়েট ছাত্রলীগের উপদপ্তর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ একটি মোবাইল ফোন এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম ওরফে তানভীর আরেকটি মোবাইল ফোন চেক করেন। একই বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের মুনতাসির আল জেমি আবরারের কাছ থেকে তাঁর ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড নিয়ে খুলে চেক করেন। আবরারের ডিভাইসগুলো তাঁরা যখন চেক করছিলেন, তখন মেহেদী হাসান এবং বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক মো. মেফতাহুল ইসলাম ওরফে জিয়ন (নেভাল আর্কিটেকচার মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র) কক্ষে আসেন। মেহেদী তাঁদের বুয়েটে কারা কারা শিবির করে তা আবরারের কাছ থেকে বের করার জন্য নির্দেশ দেন। প্রথমে মেহেদী বেশ কয়েকটি চড় মারেন আবরারকে। ওই সময় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সামসুল আরেফিন ওরফে রাফাত স্টাম্প এনে ইফতির হাতে দেন। আবরারের কাছ থেকে কথা বের করার জন্য স্টাম্প দিয়ে চার-পাঁচটি আঘাত করেন ইফতি। এতে স্টাম্পটি ভেঙে যায়। বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক অনিক সরকার (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র) স্টাম্প দিয়ে আবরারের হাঁটু, পা, পায়ের তালু ও বাহুতে মারতে থাকেন। এতে আবরার উল্টাপাল্টা কিছু নাম বলতে শুরু করেন। তখন মেফতাহুল আবরারকে চড় মারেন এবং স্টাম্প দিয়ে হাঁটুতে বাড়ি দেন।

এ সময় মেহেদী মুঠোফোনে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাসেলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। রাত সাড়ে ১০টার দিকে ইফতি ক্যানটিনে খেতে যান। মিনিট বিশেক পর ফিরে এসে দেখেন, আবরার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি মেঝেতে শুয়ে আছেন। তিনি তখন আবরারকে ধমক দিয়ে উঠে দাঁড় করান। কয়েকটি চড় মারেন। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মুজাহিদুর রহমান তখন কক্ষে থাকা স্কিপিং রোপ দিয়ে আবরারকে মারেন। ইফতি আবার স্টাম্প দিয়ে আবরারের হাঁটু ও পায়ে আঘাত করেন। তাবাখখারুল তখন চড়-থাপ্পড় মারেন। রাত ১১টার দিকে অনিক সরকার আবার কক্ষে আসেন। হঠাৎ অনিক স্টাম্প দিয়ে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে এলোপাতাড়ি শতাধিক আঘাত করেন। অনিক খুবই অনিয়ন্ত্রিতভাবে আবরারকে মারতে থাকেন। তাঁর মারা দেখে সবাই ভয় পেয়ে যান। আনুমানিক রাত ১২টার পর অনিক আবরারকে মারা থামিয়ে কক্ষের বাইরে যান। তখন আবরার অসুস্থ হয়ে পড়ে ছিলেন। তাঁর শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। এ অবস্থা দেখে আবরারের মাথার নিচে দুটি বালিশ দেন ইফতি। এর কিছুক্ষণ পরই আবরার বমি করেন। মুঠোফোনে বিষয়টি অনিককে জানানো হলে তিনি আবরারকে গোসল করিয়ে হাতে-পায়ে মলম লাগিয়ে দিতে বলেন। এ সময় আবরার দ্বিতীয়বার বমি করেন। তখন আবরারের কক্ষ থেকে তাঁর কাপড়চোপড় নিয়ে আসা হয়। তখন মেহেদী আবরারকে দেখে বলেন, ‘ও নাটক করছে’।

ইফতি বলেন, এরপর আবরারকে ২০০৫ নম্বর কক্ষে নিয়ে শুইয়ে দেওয়া হয়। এ সময় অমিত খুদে বার্তা পাঠালে তিনি সবকিছু জানতে চান এবং আবরারকে আরও মেরে আরও তথ্য বের করতে বলেন। আবরারের অবস্থা খুব খারাপ জানালে অমিত তাঁকে হল থেকে বের করে দিতে বলেন। এর কিছুক্ষণ পর মেহেদী ও অনিক ২০০৫ নম্বর কক্ষে আসেন। আবরারকে দেখে তাঁরা বলেন, ‘ও ঠিক আছে।’ এরপর তাঁরা চলে যান। এ সময় আবরার আবার বমি করেন। মেহেদী তখন আবরারকে পুলিশের হাতে দেওয়ার জন্য নিচে নামাতে বলেন। ১৭ ব্যাচের ছেলেরা আবরারকে নিচে নামানোর চেষ্টা করেন। ব্যর্থ হলে তোশকসহ আবরারকে ধরে দোতলা ও নিচতলার সিঁড়িতে নামিয়ে রাখেন। তখন আবরার বলছিলেন যে তাঁর খুব খারাপ লাগছে। সাধারণ সম্পাদক রাসেল তখন নিচে নেমে হলের প্রধান ফটকে পুলিশের সঙ্গে কথা বলছিলেন। এ সময় মুনতাসির দৌড়ে এসে বলেন, আবরারের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। ইফতি তাঁকে মালিশ করতে বলেন। ইসমাইল ও মনির তখন অ্যাম্বুলেন্সে ফোন দেন। অ্যাম্বুলেন্স আসতে দেরি হওয়ায় তামিম বাইক নিয়ে বুয়েট মেডিকেলের চিকিৎসক নিয়ে আসেন। চিকিৎসক আসার পরপরই অ্যাম্বুলেন্স আসে। চিকিৎসক সিঁড়িতে আবরারকে দেখে বলেন, ‘ও মারা গেছে।’ পরে ইফতি একটি কক্ষে গিয়ে শুয়ে থাকেন। সেখান থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে।

নির্লিপ্ত এক উপাচার্য
আবরার হত্যাকাণ্ডের পুরোটা সময় বুয়েটের উপাচার্য সাইফুর ইসলামের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠে। হলের ভেতরে এক সহপাঠীর এমন নির্মম হত্যার বিচারে উত্তাল হয় বুয়েটের সব শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনে নামেন তারা। যোগ দেন সাবেকেরাও। নানা বিবৃতি দিতে থাকেন সমাজের বিশিষ্ট পর্যায়ের মানুষেরা। অথচ নির্বাক থাকেন উপাচার্য। এমনকি ৭ অক্টোবর রাতে বুয়েটে আবরারের জানাজাতেও দেখা যায় না উপাচার্যকে। পরদিন ৮ অক্টোবর কুষ্টিয়ায় কুমারখালী উপজেলায় রায়ডাঙ্গা গ্রামে দাফন করা হয় আবরারকে। সেখানে সহস্র মানুষ অংশ নেন। ছিলেন না উপাচার্য।

পরে এ ঘটনার ৪১ ঘণ্টা পর ৮ অক্টোবর ক্যাম্পাসে উপস্থিত হয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েন উপাচার্য। ৯ অক্টোবর আবরারের কবর জিয়ারত করতে রায়ডাঙা গ্রামে যান তিনি। সেখানে গিয়ে কবর জিয়ারতের পর আবরারের মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলে আবরারের স্বজন ও গ্রামবাসীর তোপের মুখে পড়েন উপাচার্য। সেখানে ধাক্কাধাক্কি ও জটলার সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি খারাপ দেখে আবরারের বাড়িতে না গিয়ে পুলিশের সহায়তায় দ্রুত স্থান ত্যাগ করে চলে যান তিনি। পরে বুয়েট ক্যাম্পাসে এসে আবরার ফাহাদ হত্যার পর নিজের কিছু ‘ঘাটতি’ রয়েছে উল্লেখ করে শিক্ষার্থীদের কাছে ক্ষমা চান উপাচার্য অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম।

বুয়েটে নিষিদ্ধ হলো ছাত্ররাজনীতি
আবরারের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে কেউ হারিয়েছে সহপাঠী, কেউ হারিয়েছে বন্ধু, কেউ অনুজ, কেউবা হারিয়েছে তার অগ্রজকে। সবাই যেন এক হয়ে যায় আবরার হত্যার বিচারে। সেই সঙ্গে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধসহ ১০ দফা দাবিতে আন্দোলনে নামে। তাদের দাবিগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল, খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সিসিটিভি ফুটেজ ও জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে শনাক্তকারী খুনিদের প্রত্যেকের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সিসিটিভি ফুটেজ থেকে শনাক্ত করা সবাইকে ১১ অক্টোবর, ২০১৯ বিকেল পাঁচটার মধ্যে আজীবন বহিষ্কার নিশ্চিত করতে হবে, বুয়েটে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে ও আবাসিক হলগুলোতে র‍্যাগের নামে ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর সব ধরনের শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন বন্ধে করতে হবে এবং এ ধরনের সন্ত্রাসে জড়িত সবার ছাত্রত্ব প্রশাসনকে বাতিল করতে হবে।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পঞ্চম দিনে ১১ অক্টোবর বিকেলে বুয়েট অডিটোরিয়ামে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এক বৈঠকে উপাচার্য তাদের এসব দাবি পূরণের কথা জানান। বুয়েটে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করার কথা ঘোষণা করা হয়। সেই সঙ্গে আবরার হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত ১৯ শিক্ষার্থীকে বুয়েট থেকে সাময়িক বহিষ্কার করার কথা জানান উপাচার্য।

প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস
১৪ অক্টোবর আবরার ফাহাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার আশ্বাস দেন প্রধানমন্ত্রী। আবরারের পরিবারকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি ঘটনাটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। আমি দেখতে চাইনি কে কার লোক। অপরাধী কে বা কোন দল করে সেটা বিবেচনা করিনি।’

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আবরার হত্যা
আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা দেশের সীমা পেরিয়ে সাড়া ফেলেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও। বিবিসি, রয়টার্স, ওয়াশিংটন পোস্ট, নিউইয়র্ক টাইমস, আল জাজিরা, গালফ নিউজসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে বুয়েটের বর্বর হত্যাকাণ্ডটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। উঠে এসেছে বাংলাদেশজুড়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের খবর।

৯ অক্টোবর বিবিসিতে প্রকাশিত খবর বলছে ৪ ঘণ্টা ধরে পিটিয়ে হত্যা করা হয় আবরার ফাহাদকে। বিবিসির ওই খবরে নাম প্রকাশ না করে প্রত্যক্ষদর্শী বুয়েটের এক শিক্ষার্থীর বরাত দিয়ে জানানো হয়, রোববার দিবাগত রাত দুইটার সময়ও জীবিত ছিলেন আবরার। বুয়েটের জুনিয়র কয়েকজন শিক্ষার্থী আবরারকে ধরে নিচের সিঁড়িতে নিয়ে যাচ্ছিল। সে সময় আবরার বলছিলেন, ‘আমাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাও।’ বুয়েটে এ ধরনের নির্যাতন ও সহিংসতার ঘটনা প্রায় ঘটে বলেও জানানো হয় বিবিসির ওই খবরে।

আবরার হত্যায় বুয়েটসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের খবর গুরুত্বসহকারে প্রকাশ করেছে রয়টার্স। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারের পানিচুক্তির সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ায় আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বলে রয়টার্সের খবরে জানানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবির বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে রয়টার্স।

আবরার ফাহাদ হত্যার প্রতিবাদে বাংলাদেশে বিক্ষোভ শিরোনামে খবর প্রকাশ করেছে ওয়াশিংটন পোস্ট। ওই খবরে বলা হয়, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের পানিচুক্তির সমালোচনা করে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ায় আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। আবরার হত্যাকারীদের বিচার হবেই বলে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া আশ্বাসের কথাও প্রকাশ করা হয়েছে।

আবরার হত্যায় গ্রেপ্তার যারা
আবরার হত্যার ঘটনায় এখন পর্যন্ত পুলিশ ২১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। আসামিদের মধ্যে মেহেদী হাসান রাসেল, মুহতাসিম, মেহেদী হাসান রবিন, অনিক, মেফতাহুল, মনিরুজ্জামান, ইফতি, মুনতাসির, এহতেশামুল ও মুজাহিদুরকে বহিষ্কার করেছে ছাত্রলীগ। বিডি নিউজ ২৪ জানিয়েছে, ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত ১১ জনের মধ্যে একজনের নাম এজাহারে কিংবা গ্রেপ্তারের তালিকায় নেই। তিনি বুয়েট ছাত্রলীগের উপদপ্তর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ (কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, তৃতীয় বর্ষ)।

এজাহারে নাম না থাকা চারজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। তারা হলেন বুয়েট ছাত্রলীগের গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ইসতিয়াক আহমেদ মুন্না (মেকানিক্যাল, তৃতীয় বর্ষ), অমিত সাহা (সিই), মিজানুর রহমান (ওয়াটার রিসোর্সেস, ১৬তম ব্যাচ) ও শামসুল আরেফিন রাফাত (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং)।

এজাহারভুক্ত আসামিদের মধ্যে শাদাত, এহতেশামুল, মোর্শেদ ও মোয়াজ এখনো পলাতক।

ঢাকা কলেজ ছেড়ে দিল আবরারের ভাই

আবরারের সঙ্গে সঙ্গে যেন তাঁর পরিবারের সদস্যদের স্বপ্নেরও মৃত্যু হয়েছে। ভাইয়ের মৃত্যুর পর ঢাকা কলেজ ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় আবরার ফায়াজ। ছাড়পত্র নিয়ে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে ভর্তি হয়েছে সে।

ছাত্রলীগের নৃশংসতার শেষ কোথায়
আবরার হত্যার ঘটনায় উঠে এসেছে নির্মম এক সত্য। ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেশ কয়েকটি নিষ্ঠুর ও নৃশংস ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ছাত্রলীগের নাম। প্রথম আলোর হিসাবে ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে ছাত্রলীগের নিজেদের কোন্দলে নিহত হন ৩৯ জন। আর এই সময়ে ছাত্রলীগের হাতে প্রাণ হারান অন্য সংগঠনের ১৫ জন।

২০০৯ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের একাংশের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আসাদ ওরফে রাজীবকে হত্যা করে লাশ বহুতল ভবন থেকে ফেলে দেওয়া হয়। ২০১০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কর্মী নাসরুল্লাহ নাসিমকে নিজ সংগঠনের কর্মীরাই মারধর করে বহুতল ভবন থেকে ছুড়ে ফেলে হত্যা করেন। ২০১০ সালে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী আবুবকর সিদ্দিক। একই বছর ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে মারা যান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ। ২০১২ সালে ছাত্রলীগ নেতাদের চাপাতির কোপে প্রাণ হারান পুরান ঢাকার দরজি বিশ্বজিৎ দাস।

ভিন্নমতের জের ধরে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, আমরা এখনো সহিষ্ণু হতে শিখিনি। একটি ঘটনায় শেষ হয়ে গেল কতগুলো জীবন। যিনি মারা গেলেন তিনিও যুবক, যারা মারল তারাও যুবক। মেধাবী আর তাজা প্রাণগুলোর এমন অপচয় সত্যিই মেনে নেওয়া যায় না।