বিনা মূল্যে আইনি সেবা নিয়েছে সাড়ে ৪ লাখ মানুষ

দুই বছর আগে দেনমোহর ও ভরণপোষণ আদায়ের জন্য জেলা লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে গিয়ে আবেদন করেন কুড়িগ্রামের কৃষ্ণপুর পাইকপাড়া গ্রামের রেশমা বেগম। স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়ে বছর দুই আগে বাবার বাড়িতে ফিরে আসেন। তাঁর ছেলের বয়স তখন পাঁচ। যৌতুক না পেয়ে স্বামী সাইদুল পরে তাঁকে তালাক দেন।

এ অবস্থায় এক আত্মীয়ের কাছে রেশমা জানতে পারেন জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের কথা। ২০১৭ সালের নভেম্বরে তিনি সেখানে গিয়ে আইনগত সাহায্যের আবেদন করেন। জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা রেশমার পক্ষে মামলা লড়তে ওই বছরই আইনজীবী নিয়োগ দেন, শুরু হয় কার্যক্রম। পারিবারিক এই মামলায় চলতি বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর রেশমার পক্ষে রায় হয়।

জানতে চাইলে রেশমা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলা চালাতে আমার একটি পয়সাও খরচ হয়নি। দেনমোহরের অর্থ বুঝে পেয়েছি। লিগ্যাল এইড অফিস আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।’

রেশমার মতো এমন আর্থিক অসচ্ছল ভুক্তভোগীদের বিনা মূল্যে আইনি সেবা দিয়ে যাচ্ছে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত ১০ বছরে ৪ লাখ ৫৮ হাজার ৫৬ জন ব্যক্তি সরকারি আইনি সহায়তা পেয়েছেন। এর মধ্যে আইনি পরামর্শ, আদালতে মামলা পরিচালনা, শ্রমিক সহায়তা, বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তি ও তথ্যসেবা রয়েছে।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৯ সালে ৯ হাজার ১৬০ জন জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা থেকে আইনি সহায়তা পান। ১০ বছরের মাথায় এই সংখ্যা এখন তিন গুণের বেশি। গত বছরে এই সংস্থা থেকে আইনি সহায়তা পেয়েছেন ৩৪ হাজার ৭২০ জন।

আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার তথ্য অনুসারে, শুধু দেশের ৬৪টি জেলা লিগ্যাল এইড অফিস থেকে ১০ বছরে সরকারি আইনি সহায়তা নিয়েছেন ৩ লাখ ৪৭ হাজার ৬৫৭ ব্যক্তি।

অসহায় ও অসচ্ছলদের বিনা মূল্যে আইনি সহায়তা কার্যক্রমে এখন বিকল্প পদ্ধতিতে (এডিআর) মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। দেশের জেলা লিগ্যাল এইড কার্যালয়গুলোকে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির কেন্দ্র হিসেবে তৈরি করা হচ্ছে। এ কার্যক্রমকে আরও ফলপ্রসূ করতে জেলা পর্যায়ে বেঞ্চ সহকারী ও জারিকারকের জন্য ৯৬টি পদ সৃষ্টি করা হয়েছে, এ নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন।

জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার জাতীয় পরিচালনা বোর্ডের অন্যতম সদস্য আইনসচিব মো. গোলাম সারওয়ার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত ১০ বছরে সাড়ে ৪ লাখের বেশি মানুষকে আইনি সহায়তা দেওয়া হয়েছে। সেবা প্রক্রিয়া সহজীকরণ, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে লিগ্যাল এইড কমিটিগুলো সক্রিয় করা, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ও প্যানেল আইনজীবীদের ফি বৃদ্ধি এই সেবা কার্যক্রমের ব্যাপ্তি বাড়িয়েছে। উন্নত বিশ্বে এখন আদালতে মামলা করার চেয়ে আদালতের বাইরে বিরোধ নিষ্পত্তিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এই ধারণা সামনে রেখে আইনমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগে এডিআর কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করার জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে।

যাত্রা শুরুর পূর্বাপর

২০০০ সালে আর্থিকভাবে অসচ্ছল, সহায়সম্বলহীন ও নানাবিধ আর্থসামাজিক কারণে বিচার পেতে অসমর্থ জনগণকে সরকারি খরচে আইনি সহায়তা দিতে ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০’ করা হয়। ওই আইন অনুসারে ২০০১ সালে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা গঠন করা হয়। তবে জনবল ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অভাবসহ নানা কারণে সূচনাকাল থেকে ২০০৯ সালের আগপর্যন্ত সংস্থাটির কার্যক্রম ছিল স্থবির। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার জন্য আলাদা কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। সংস্থাটি ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি প্রতিটি জেলা আদালতে সংস্থার কার্যালয় স্থাপন ও স্থানীয় কমিটি গঠন করা হয়। সে সময় থেকে আইনগত সেবা নেওয়ার হার বাড়তে শুরু করে। এখন দেশের ৬৪ জেলায় স্থায়ী লিগ্যাল এইড কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিবছরের ২৮ এপ্রিল জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস পালিত হচ্ছে।

বেড়েছে বরাদ্দ ও পরিধি

জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা জেলা কমিটিগুলোতে যে অনুদান দিত, অনেক ক্ষেত্রেই তা খরচ হতো না। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ওই তহবিলের আওতায় ২০০৯ ও ২০১০ সালে ৬৪টি জেলায় ১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ব্যয় হয়েছিল ৬৭ লাখ ৯২ হাজার ৬৮৯ টাকা। পরের বছর ব্যয় হয় ৭৩ লাখ ৯৩ হাজার ৫৯৬ টাকা। সংস্থা সূত্রে জানা যায়, এবার (২০১৯-২০ অর্থবছর) ২০ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।

এ ছাড়া সুবিধাবঞ্চিত কারখানার শ্রমিকদের মজুরি, নিরাপত্তা ও চাকরিসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্যও আছে শ্রমিক আইনগত সহায়তা সেল। ২০১৩ থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ১৭ হাজার ৩২৪ জন এই আইনি সেবা নেন। অন্যদিকে যোগাযোগ ও আইনগত বিষয়ে পরামর্শের জন্য ২০১৬ সালের ২৮ এপ্রিল ‘সরকারি আইনি সহায়তায় জাতীয় হেল্পলাইন’–এর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়, টোল ফ্রি নম্বরটি হচ্ছে ১৬৪৩০।

মাঠপর্যায়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, স্থানীয় প্রশাসনের সম্পৃক্ততা, সেবা প্রক্রিয়া সহজীকরণ এবং কার্যক্রম তদারকিতে অভ্যন্তরীণ ই–সেবা ব্যবস্থাপনা আইনগত সহায়তা কার্যক্রমের ব্যাপক সাড়ার কারণ বলে মনে করেন সংস্থার জাতীয় পরিচালনা বোর্ডের অন্যতম সদস্য জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ এম আমিন উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মানুষ এখন নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন। তাঁরা জানেন অর্থ না থাকলে নিজের অধিকার আদায়ের জন্য লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে আইনি লড়াই চালানো যায়।