পাঁচ বছরেও সায়াদ হত্যার বিচার শুরু হয়নি

সায়াদ
সায়াদ

দুটি হত্যাকাণ্ডের মধ্যে সময়ের ফারাক পাঁচ বছর, ধরন একই। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের মতো বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সায়াদ ইবনে মোমতাজকেও তাঁর সহপাঠী ও জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থীরা পিটিয়ে হত্যা করেছিলেন। ওই ঘটনায় ১৪ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু বিচার শুরুর আগেই অব্যাহতি পান সাতজন। দুজন পালিয়ে গেছেন। অব্যাহতির জন্য আরও দুজনের করা রিটের নিষ্পত্তি না হওয়ায় পাঁচ বছরেও বিচার শুরু হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পলাতক আসামিদের একজন মিজানুর রহমান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে কর্মরত, এখন থাইল্যান্ডে আছেন। সুমন পারভেজ ও অন্তর চৌধুরী অব্যাহতি পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ করেছেন। জামালপুরের সাংসদ শফিকুল ইসলাম খোকার ছেলে মো. ফয়সাল ইসলাম এলাকায় রাজনীতি করছেন। তবে রেজাউল করিমের বিষয়ে তথ্য কেউ দিতে পারেননি। অপর দুই গুরুত্বপূর্ণ  আসামি সুজিত ওরফে সুজয় কুমার কুণ্ডু এলাকায় প্রাইভেট পড়িয়ে সংসার চালান, রোকনুজ্জামানের অবস্থান জানা যায়নি।

সায়াদ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ছাত্র ছিলেন। রাজশাহীর ছেলে সায়াদ থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আশরাফুল হক হলের বি ব্লকের ৩১২ নম্বর কক্ষে। ছাত্রলীগের হল শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন তিনি। ২০১৪ সালের ৩১ মার্চ বিকেলে ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম তাঁকে ২০৫ নম্বর কক্ষে ডেকে পাঠান। এর কয়েক দিন আগে সায়াদ ইসলামী ছাত্রশিবিরের অনুসারী—এমন খবর ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

ঘটনার দিন রেজাউলের নির্দেশে অন্যরা সায়াদকে ক্রিকেটের স্টাম্প দিয়ে পেটান। ২০৫ নম্বর কক্ষে আগে থেকেই সাদেকুর রহমান খান ওরফে স্বপন, পলাশ, শাহজালাল সুমন, মুফরাত, প্রশান্ত কুমার দে, রাহুল ও রিয়াদ অবস্থান করছিলেন। সন্ধ্যা ৬টার দিকে রেজা ও স্বপন সায়াদকে তাঁর কক্ষে রেখে আসতে বলেন। শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকলে আসামিরা চিকিৎসার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় হেলথ কেয়ারের এক চিকিৎসককে ডেকে নিয়ে আসেন। রাত সোয়া ৯টার দিয়ে সায়াদকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পাঠানো হয়। পরদিন সকালে হাসপাতাল থেকে এক্স-রে করাতে ট্রমা মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া হয় সায়াদকে। সেখানে অপেক্ষমাণ অবস্থায় মারা যান সায়াদ।

সায়াদের মৃত্যুর পরপরই প্রথমে তাঁর বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন। ওই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী একজন শিক্ষক নাম না প্রকাশ করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সায়াদ ছাত্রলীগের রাজনীতি করা বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর মতো দুর্বিনীত ছিলেন না। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবার কাছে জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁরই বন্ধু সুজয় ও রোকন তাঁকে নির্বাচনে দাঁড়াতে নিষেধ করেছিলেন। নিজেদের রাস্তা পরিষ্কার করতে সুজয় ও রোকনই প্রচার চালান সায়াদ শিবির কর্মী।

সাত আসামির অব্যাহতি, বাকিরা পলাতক ও জামিনে
অভিযোগপত্রভুক্ত ১৪ আসামি হলেন আশরাফুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম, একই হল শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক সুজয় কুমার কুণ্ডু ও রোকনুজ্জামান, সাংগঠনিক সম্পাদক নাজমুল শাহাদাত রাসেল, বাকৃবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মুর্শেদুজ্জামান খান বাবুর ভাতিজা ও ছাত্রলীগ নেতা সাদেকুর রহমান খান স্বপন (ক্যাম্পাসে ‘ভাতিজা স্বপন’ হিসেবে পরিচিত), শাহজালাল হলের ছাত্রলীগ কর্মী সুমন পারভেজ, জামাল হোসেন হলের ছাত্রলীগ কর্মী ফয়সাল ইসলাম, আশরাফুল হক হলের ছাত্রলীগ কর্মী দেওয়ান মুহাম্মদ মুনতাকা মুফরাত, প্রশান্ত কুমার দে, মাহমুদ হাসান, পশুপালন অনুষদের মো. মনোয়ারুল ইসলাম, মো. রোকনুজ্জামান, মো. মিজানুর রহমান ওরফে শাওন ও অন্তর চৌধুরী।

আদালত রেজাউল, নাজমুল, মুনতাকা মুফরাত, ফয়সাল ইসলাম, সুমন পারভেজ, অন্তর চৌধুরী ও মাহমুদ হাসানকে অব্যাহতি দেন। মিজানুর রহমান ও প্রশান্ত দে পালিয়ে যান। বাকি পাঁচজন রোকনুজ্জামান, সুজয় কুমার কুণ্ডু, রোকনুজ্জামান (২), সাদেকুর রহমান খান স্বপন ও মনোয়ারুল ইসলাম জামিনে বেরিয়ে আসেন।

ময়মনসিংহ জেলা জজকোর্টের কৌঁসুলি খালেকুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদালত সাতজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। আমি আদালতকে বলেছিলাম, যাঁদের অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে তাঁরা খুনি। তারপরও আদালত তাঁদের অব্যাহতি দেন।’

আদালত যাঁদের অব্যাহতি দেন তাঁদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী রেজাউল করিমকে আজীবন, নাজমুল শাহাদাত ও মুনতাকা মুফরাতকে চার বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য লুৎফুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, সায়াদ হত্যাকাণ্ডের পর মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষক মহসীন আলীকে প্রধান করে ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়ে ছয়জনকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করা হয়েছিল। নিম্ন আদালত অভিযুক্তদের অব্যাহতি দেওয়ার পর তাঁরা উচ্চ আদালতে যাননি বলে নিশ্চিত করেন উপাচার্য।

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন নাটোর ও জামালপুর প্রতিনিধি)