টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা জরুরি

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। পাশে ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম। গতকাল কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে।  ছবি: প্রথম আলো
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। পাশে ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম। গতকাল কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে। ছবি: প্রথম আলো

প্রতিদিন ঢাকার দুই সিটিতে প্রায় ৬ হাজার ২৫০ টন বর্জ্য তৈরি হয়। কিন্তু মেগাসিটি ঢাকায় এখনো আধুনিক, টেকসই ও উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। এই বর্জ্য পরিবেশদূষণের পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা না গেলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে।     

গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে এসব বক্তব৵ উঠে আসে। ‘ঢাকা মহানগরীতে টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সন্ধানে’ শীর্ষক বৈঠকটির আয়োজন করে প্রথম আলো এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) অ্যালামনাই। বৈঠকে সূচনা বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।  

বর্জ্যকে সম্পদ উল্লেখ করে জাতীয় অধ্যাপক ও বুয়েট অ্যালামনাইয়ের সভাপতি জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, দৈনিক যে পরিমাণ বর্জ্য হয়, তার পুরোটা সিটি করপোরেশন সংগ্রহ করতে পারে না। অসংগৃহীত বর্জ্য খাল, নালায় ফেলা হচ্ছে। বর্জ্য রিসাইকেল (পুনর্ব্যবহারের জন্য প্রক্রিয়াজাত করা) করার পরিমাণও কম। যেসব পরিচ্ছন্নতাকর্মী বর্জ্য সংগ্রহ করেন, তাঁদের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টিও উপেক্ষিত।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, লোকজন খালকে ডাস্টবিন হিসেবে ব্যবহার করছে। ডাব, কোমল পানীয় পান করার প্লাস্টিক স্ট্র দিয়ে নালা ভরে থাকছে। শহরের সবাই নাগরিক, কিন্তু সুনাগরিক কতজন? শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

২০২১ সাল নাগাদ শুধু ডিএনসিসি এলাকাতে দৈনিক ৫ হাজার ২০০ টন বর্জ্য তৈরি হবে উল্লেখ করে আতিকুল ইসলাম বলেন, এত বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা ইনসিনারেশন (বর্জ্য পোড়ানো) ছাড়া সম্ভব নয়। দুটি ইনসিনারেশন প্ল্যান্টসহ ইকোপার্ক করার জন্য সরকারের কাছে ৮২ একর জমি চাওয়া হয়েছে। টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়তে সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

টাঙ্গাইলের সখীপুর পৌরসভা গৃহস্থালি বর্জ্য এবং মনুষ্য বর্জ্য একত্রে ব্যবহার করে মাত্র তিন কাঠা জায়গার ওপরে নিজস্ব পদ্ধতিতে সার উৎপাদন করছে। বিষয়টি উল্লেখ করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান সুলতান আহমেদ বলেন, এমন দেশীয় প্রযুক্তিকে আরও বড় আকারে প্রয়োগ করা যেতে পারে। ঢাকার চারপাশের নদী মহাপরিকল্পনাতেও কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের ইমেরিটাস অধ্যাপক এম ফিরোজ আহমেদ। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশে বর্জ্য উন্মুক্ত ল্যান্ডফিল্ড পদ্ধতিতে চূড়ান্ত ডিসপোজ করা হয়। এই উন্মুক্ত ল্যান্ডফিল্ড মোটেও পরিবেশসম্মত নয়। প্রবন্ধে ঢাকার দুই সিটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়।    

শুধু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করবে—এমন একটি কমিশন গঠন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শাহজাহান মোল্লা। তিনি বলেন, কঠিন বর্জ্য, তরল বর্জ্য এবং বায়বীয় দূষণের জন্য কাজ করবে—এমন একটি স্বতন্ত্র কমিশন গঠন এখন সময়ের দাবি।

পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক বলেন, ‘সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট রুলস’ (কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা) প্রণয়নের কাজ চলছে। এই বিধিতে উৎস থেকে বর্জ্য আলাদা করার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

বর্জ্যকে দীর্ঘদিনের ‘গলার কাঁটা’ উল্লেখ করে বিদ্যুৎ বিভাগের পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ বেশি পড়বে। কিন্তু টাকার দিকে তাকালে চলবে না। খরচ বেশি পড়লেও বর্জ্য থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিনতে সরকার প্রস্তুত আছে।

উৎসেই অনেক বর্জ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে মন্তব্য করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসাইন বলেন, সিটি করপোরেশন এলাকায় উৎপাদিত বর্জ্য পুরোটা সংগ্রহ করতে হবে। তা না হলে পরিবেশের ক্ষতি হতেই থাকবে। কঠিন বর্জ্য থেকে রিসাইকেল করার মতো জিনিসগুলো আলাদা করেন পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। সেটিও খুব পরিবেশসম্মত নয়।

ঢাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একক কোনো সমাধান নেই বলে মনে করেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল হাসনাত মো. আশরাফুল আলম। 

বর্জ্য পরিবহন নিয়ে সিটি করপোরেশনে সিন্ডিকেট থাকার কথা উল্লেখ করে বুয়েটের কেমিক্যাল প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, এর আগে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একাধিক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সিটি করপোরেশন বর্জ্য না দেওয়ায় প্রকল্পগুলো ব্যর্থ হয়েছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেক মডেলের প্রস্তাব এসেছে। ছোট বা মাঝারি আকারে পাইলট ভিত্তিতে এগুলো প্রয়োগ করে দেখা যেতে পারে।